দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে একাধিক সংঘবদ্ধ মানবপাচার চক্র। এদের প্রধান টার্গেট রোহিঙ্গা নারী-শিশু। অর্থের বিনিময়ে তারা রোহিঙ্গাদের এদেশে অনুপ্রবেশে সহযোগিতা করার পাশাপাশি ভালো চাকরি ও উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাচার করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে মাঝেমধ্যে পাচারকারীদের কবল থেকে রোহিঙ্গাদের উদ্ধার ও চক্রের সদস্যরা গ্রেফতার হলেও এদের দৌরাত্ম্য কিছুতেই থামছে না। সম্প্রতি কক্সবাজারের টেকনাফকেন্দ্রিক মানব পাচার ঠেকাতে কখনো গহিন পাহাড়ে আবার কখনো সাগর উপকূলে একের পর এক ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত এক মাসে ১৩টি অভিযানে ৩৪৭ জন ভুক্তভোগীকে উদ্ধার ও ৪৭ পাচারকারীকে আটক করেছে বিজিবি, র্যাব ও কোস্ট গার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এটি নিশ্চয়ই আশাব্যঞ্জক।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার বিষয়ক প্রতিবেদন ট্রাফিকিং ইন পারসনস রিপোর্ট-২০২৫ প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার মানবপাচার রোধে কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবে এখনো ন্যূনতম মান পূরণে ব্যর্থ। তার আগে ইউএনএইচসিআর ও আইওএম এক বিবৃতিতে বলেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাচার এখন সবচেয়ে বড় হুমকি।
আন্তর্জাতিক সহায়তা না বাড়লে তারা আরো বিপদে পড়বে। মানবপাচার অপহরণ বা জোরপূর্বক হতে পারে। কিন্তু অনেককে মিথ্যা চাকরির প্রলোভন, উন্নত আয় ও উন্নত বসবাস প্রাপ্তির আশায়ও পাচারের শিকার হতে দেখা যায়। পুরুষদের ক্ষেত্রে ভালো চাকরি এবং নারী, শিশু-কিশোরীদের পাচারের ক্ষেত্রে ভালো চাকরি, নায়িকা বা মডেল বানানোর লোভ দেখানো হয়ে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে ফাঁদ পেতেও ইদানীং মানবপাচার হচ্ছে।
বাংলাদেশের টেকনাফ হয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে অবৈধ অনুপ্রবেশের একটি জনপ্রিয় রুট। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ রুটে প্রতিবছর ঝুঁকিপূর্ণভাবে সাগরপথে প্রায় ৫০ হাজার লোক মালয়েশিয়ায় পাচার হয়। এ ছাড়া কাউকে আবার থাইল্যান্ডের গহিন জঙ্গলে আটকে রাখার পর ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনাও দেখা যায়। রোহিঙ্গাদের মাঝ থেকে বিশাল একটি অংশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানব পাচারকারীরা উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে পাচার করছে।
বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন নামে একটি শক্তিশালী আইন প্রণয়ন করে। কার্যত তার প্রয়োগ নেই । এ আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া দ্রুত বিচারের জন্য ‘মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল’ প্রতিটি জেলায় গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার মানবপাচার রোধে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। কেননা, সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে সাধারণত ভারত হয়ে মানবপাচার বেশি হয়ে থাকে। এ ছাড়া মানবপাচার রোধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে। ‘পালেরোমা চুক্তি’ নামে একটি আন্তর্জাতিক প্রটোকল প্রণয়ন করা হয়।
তবে এতকিছুর পরও থামছে না মানবপাচার। ‘দ্য গ্লোবাল অ্যাকশন এগেইনস্ট ট্রাফিকিং ইন পারসন অ্যান্ড স্মাগলিং মাইগ্রেনস বাংলাদেশ’ প্রকল্পের অধীনে ইউএনওডিসি এবং আইওএমের সমন্বয়ে বাংলাদেশ মানবপাচার রোধে কাজ করে যাচ্ছে। মানবপাচার প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে কাগজে-কলমে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবে সেগুলোর বাস্তবায়ন চোখে পড়ে না। ফলে প্রতিবছরই আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) হিসাবে মানবপাচারে ঘুরেফিরে শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যেই থাকছে বাংলাদেশ। আর চলতি বছরে তো এ তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। ফলে মানবপাচার নির্মূলের জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
মানবপাচার রোধে আইনের প্রয়োগ, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়, পাচারের রুটগুলোতে অত্যাধুনিক মনিটরিং যন্ত্রপাতি স্থাপন জরুরি। পাচারকারী চক্রকে আইনের আওতায় এনে বিশেষ করে গ্রেফতার করে যথাসম্ভব আইনের শাসন নিশ্চিত করা গেলে পাচারকারীরা হয়তো কিছুটা থামবে। এর পাশাপাশি জনসচেতনতা তৈরি করতে পারলেই কার্যকর নিয়ন্ত্রণের দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ।
কেকে/এজে