ইতিহাসের কিছু ঘটে যাওয়া ঘটনা দিয়ে শুরু করি। লেখতে গেলে পাণ্ডিত্য লাগে, পাণ্ডিত্য ছাড়া লেখালেখির প্রচার প্রসার হয় না। আর মাঝে মাঝে ইতিহাসের ঘটনা না বললে তো আর পাণ্ডিত্য থাকে না। তবে আমার আজ ইতিহাসে ফিরে যাওয়া পাণ্ডিত্য প্রকাশের জন্য নয়। তবে এই লেখার উদ্দেশ্য নীতি-নির্ধারকের দৃষ্টি আকর্ষণ- সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর এই দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত না দেশের জন্য, সেই বিষয়ে আমার নিজেরই সন্দেহ আছে। ঘটনাগুলো দেখি।
(১) সাবেক মিশরীয় রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাতের হত্যাকারীকে প্রশ্ন করেছিলেন বিচারক, “প্রেসিডেন্ট সাদাতকে কেন হত্যা করেছ তুমি? হত্যাকারী জবাব দিয়েছিল, “কারণ সে সেক্যুলার ছিল।” বিচারক তখনই পরের প্রশ্নটি করলেন, “সেক্যুলার মানে কী” হত্যাকারী জানাল, “আমি জানি না।”
(২) প্রয়াত মিশরীয় লেখক নাগিব মাহফুজকে ছুরি মেরে হত্যা করে। হত্যাচেষ্টাকারীর একজনকে প্রশ্ন করেছিলেন বিচারক, “নাগিব সাহেবকে তুমি ছুরিকাঘাত করেছ কেন?” জবাবে সন্ত্রাসী বলেছিল, “কারণ সে ধর্মবিরোধী ‘চিলড্রেন অভ গেবালাবি’ উপন্যাসটি লিখেছে।” বিচারক আগ্রহ দেখালেন, “উপন্যাসটি পড়েছ তুমি?” অপরাধী জবাব দিয়েছিল, “না।”
(৩) মিশরীয় সাহিত্যিক ফারাজ ফাউদাকে হত্যাকারী সন্ত্রাসীটিকে বিচারক প্রশ্ন করেছিলেন, “ফারাজ ফাউদাকে মেরে ফেললে কেন?” হত্যাকারী জবাব দিয়েছিল, “কারণ তার ইমান নাই।” বিচারক জানতে কৌতূহলী হলেন, “তুমি কিভাবে বুঝলে যে তার ইমান নাই?” সন্ত্রাসীর জবাব ছিল, “তার বইগুলা পড়লেই সব বোঝা যায়।” বিচারকের কৌতূহল বেড়ে গেল,‘‘তার কোন বইটিতে তুমি তার ইমানহীনতার প্রমাণ পেলে?” হত্যাকারী স্বীকার করল, “বইয়ের নাম আমি জানি না। আমি পড়িনি ওসব।” বিচারক বিস্মিত হলেন, “কেন পড়নি”? খুনি বলেছিল, “আমি লিখতে-পড়তে জানি না”।
৩১ দফায় রয়েছে সংস্কারের মতো কঠিন শব্দ, সংবিধানের মতো কঠিন বিষয়, পুনর্গঠনের মতো জটিল শব্দ, রয়েছে আইনসভা-মন্ত্রীসভা-বিচার বিভাগের মতো জ্ঞানী ও আভিজাত্য শব্দ। যে শব্দগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি তাদের জ্ঞানের আভিজাত্য প্রকাশে ব্যস্ত। জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি তাদের জ্ঞানের আভিজাত্য প্রকাশের মাধ্যমে যতই ৩১ দফা বুঝানোর জন্য লেকচার দিক না কেন তা গ্রহণ বা ধারণ করার ক্ষমতা অধিকাংশ শ্রোতারই নেই। এটি শ্রোতার অজ্ঞতা নাকি বক্তার অজ্ঞতা তা বলা মুসকিল। তবে বক্তার শ্রোতাদের বিষয়ে জ্ঞান না থাকাটা কিন্তু সম্পূর্ণই অজ্ঞতা, ৩১ দফার উদ্দেশ্য না বুঝতে পারাটাও অজ্ঞতা।
অনেকে আবার ৩১ দফার মিটিংয়ে উপস্থিত থাকাকেও জ্ঞানী-গুণী মনে করছেন। কিন্তু ৩১ দফা নিয়ে একটি প্রশ্ন করলে উত্তর কিন্তু উপরের আসামিদের মতো বলতে তাদের কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। অজ্ঞতা কখনোই গুরুত্বপূর্ণ বা জ্ঞানের বিষয়ের পরিধিকে প্রসার করে না বরং গুরুত্বপূর্ণ বা জ্ঞানের বিষয়কে অযুক্তিক বা অপ্রয়োজনীয় হিসেবে উপস্থাপন করে। অজ্ঞতার কারণেই অনেক বড় বড় অপরাধ ঘটেছে পৃথিবীতে। অজ্ঞতার কারণে মানুষ অন্যায় কাজ গর্বের সঙ্গে করে বুক ফুলিয়ে চলতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন দফা বা নির্বাচনি ইশতেহারের মূল লক্ষ্যই জনগণের সুযোগ-সুবিধা বা কল্যাণ। সব ধর্ম ও সব শ্রেণীর মানুষের জন্যই দফা বা নির্বাচনি ইশতেহার বানান হয়, যার জন্য একজনের জন্য দফা অন্যজনের নিকটে অপ্রয়োজনীয় বা অপ্রসাঙ্গিক মনে হতে পারে। যে কোনো দফা বা নির্বাচনি ইশতেহারে স্পষ্ট অঙ্গীকারের মাঝেও অস্পষ্টতা থাকে। এই অস্পষ্টতাকে হাসিনার ১০ টাকা সের চাল আর ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার অঙ্গীকার ভাঙার কারণে আরো অস্পষ্ট করে তুলেছে। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে দফা বা নির্বাচনি ইশতেহার না দিলে জনগণের প্রাপ্তির সম্ভবনা অস্পষ্টতার কালো মেঘে বিলীন হয়ে যাবে। বিগত ১৫ বছরে স্বৈরাচারী হাসিনার আচরণে এ দেশের মানুষ দফা বা নির্বাচনি ইশতেহারকে অপ্রয়োজনীয় বা হাস্যকর মনে করতে অভ্যস্ত হয়েছে।
দফা বা নির্বাচনি ইশতেহারকে অপ্রয়োজনীয় বা হাস্যকর করার কারিগরও কিন্তু স্বৈরাচারী হাসিনা। এ দেশের মানুষদেরকে এই জায়গা থেকে বের করে আবার স্বপ্ন দেখাতে শিখানোও একটি দফা হতে পারে। স্বপ্ন ছাড়া মানুষ এগোতে পারে না। স্বপ্ন দেখতে হবে, স্বপ্ন দেখাতে হবে। দফা বা নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়ন হলে কোন শ্রেণী কোন সুবিধে পাবে? কার কার ওপর কোন কোন প্রভাব পড়বে? কৃষকদের ওপর কি প্রভাব পড়বে? শ্রমিকদের ওপর কি প্রভাব পড়বে? স্কুলছাত্রদের ওপর কি প্রভাব পড়বে? কলেজ ছাত্রদের ওপর কি প্রভাব পড়বে? মাদ্রাসার ছাত্রদের ওপর কি প্রভাব পড়বে? বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ছাত্রদের ওপর কি প্রভাব পড়বে? সরকারি/বেসরকারি চাকরিজীবীদের ওপর কি প্রভাব পড়বে? সরকারি/বেসরকারি শিক্ষকদের ওপর কি প্রভাব পড়বে? স্কুল বা কলেজের শিক্ষকদের ওপর কি প্রভাব পড়বে? গরু ব্যবসায়ীদের ওপর কি প্রভাব পড়বে? আম ব্যবসায়ীদের ওপর কি প্রভাব পড়বে? মাছ ব্যবসায়ীদের ওপর কি প্রভাব পড়বে? মুরগী ব্যবসায়ীদের ওপর কি প্রভাব পড়বে? নদী ও পানি ব্যবস্থাপনায় ওপর কি প্রভাব পড়বে? বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে ব্যবস্থাপনায় ওপর কি প্রভাব পড়বে? গ্যাস উৎপাদন ও গ্যাস ব্যবস্থাপনায় ওপর কি প্রভাব পড়বে? এসব আলোচনা সহজেই বুঝতে পারা যায়। আর তা যদি হয় তথ্য ভিত্তিক পরিসংখ্যান ভিত্তিক তাহলে তো কথাই নেই। বর্তমানে তথ্যভিত্তিক সংখ্যা ও পরিসংখ্যান মানুষের মনে গেঁথে থাকে। মানুষ অতীত নিয়ে খুব একটা ভাবে না। মানুষ ভাবে বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে।
বাংলা পড়তে পারেন এ রকম কেউ যদি ৩১ দফা রিডিং পড়েন তাহলে উনি কি বুঝবেন? সাধারণভাবে বলা যায় এক থেকে ১৫ দফা, ১ ৯ থেকে ২১ পর্যন্ত সংবিধান, সরকারের বিভিন্ন রাষ্ট্রযন্ত্রের সংস্কার-পুনর্গঠন, আইনসভা-মন্ত্রীসভা-বিচার বিভাগ, নির্বাচন, পররাষ্ট্র নীতি, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এই দফা বা বিষয়গুলো যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন সাধারণ মানুষ এই বিষয়গুলো ভাবেই না। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ নিজেদেরকে আদার ব্যাপারী ভাবে, এই দফাগুলোকে জাহাজের খবর মনে করে। এই দফাগুলো নিয়ে সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করার কোনো আকর্ষণীয় উদ্যোগ দৃষ্টিগোচরে আসেনি। সাধারণ মানুষের জন্য সহজ দ্রব্য, সহজে বোধগম্য এ রকম বিষয় সংযুক্ত করলে ভালো হবে। আশা করি আমরা অচিরেই এর আশার প্রতিফলন দেখতে পাব।
লেখক : ভাইস চেয়ারম্যান, ঢাকা সেন্টার, আইইবি, ঢাকা।
কেকে/ এমএস