বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি কোনোটি ভালো অবস্থানে নেই। অন্তর্বর্তিকালীন সরকার বছর পার করেছে। জনগণের অধির আশা আগ্রহ ছিল রাজনীতি ও অর্থনীতিতে একটি পরিবর্তন আসবে। বাস্তবে এই সময়ে দুটির মধ্যে কোনো ধরনের সন্তোষজনক পরিবর্তনের দেখা মিলছে না। বর্তমান সরকার রাজনীতিতে পরিবর্তন আনার জন্য ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছে। সেই কমিশন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনায় বসেছে। তবে দলগুলোর মধ্যে ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
রাজনীতিতে বহুদলীয় গণতন্ত্রচর্চা, বক্তব্য থাকবে। তার পরও বিদ্যমান দলগুলোর মধ্যে জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্যে আসা গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কথা। ফলে রাজনীতি এখনো দলগুলোর দলীয় রাজনীতির মধ্যে বন্দি হয়ে আছে। জনগণের বৃহত্তর আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঐকমত্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বলা যায় কমিশন বৃহৎভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনীতির অবস্থা মোটেও ভালো নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, মিল কারখানা, শিল্পজোন তাদের ব্যবসার মধ্যে কোনো প্রকারের উন্নতি অগ্রগতি সাফল্য দেখাতে পারেনি। শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে হতাশা, ছাঁটাই, আন্দোলন চলমান আছে। ব্যাংক খাতে চরম নৈরাজ্য চলছে। মুষ্টিময় দুর্নীতিবাজ কতিপয় মানুষের লুটপাটের কারণে ব্যাংক এখন সাধারণ জনগণের আমানত ফেরত দিতে পারছে না। সরকারি বেসরকারি সব ব্যাংকের অর্থনীতির প্রবাহ ক্যানসারে পরিণত হয়েছে। বিগত সরকারের সময় সেই ক্যানসার পরিষ্কারভাবে নির্ণয় না হলেও বর্তমান সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সেটি পরিষ্কার করতে পেরেছে। ফলে ব্যাংক খাতের সঙ্গে দেশের অর্থনীতির এক কঠিনতম সময় পার করছে।
এ দুয়ের মধ্যে কে কখন বড়, কে কীভাবে ছোট, কে কার দ্বারা কতখানি প্রভাবিত, উদ্বুদ্ধ কিংবা পরিচালিত হয় তা আজও বিশ্বব্যাপী কোথাও খোলাশা করা সম্ভব হয়নি। ক্ষমতাধর দেশের বড় মাদবরের মতলব মতিগতি বুঝতে হিমশিম খাচ্ছে গোটা বিশ্ব। এভাবেই যুগে যুগে স্থান, পাত্র ও প্রক্রিয়াভেদে অর্থনীতি ও রাজনীতি অধিকাংশ সময় অনিবার্যভাবেই সমতালে ও সমভাবনায় এগিয়ে চলছে। চলারই কথা। যদিও অনেক সময় এটাও দেখা গিয়েছে রাজনীতি অর্থনীতিকে শাসিয়েছে, নিয়ন্ত্রণ করেছে : আবার অর্থনীতি রাজনীতিকে অবজ্ঞার অবয়বে নিয়ে যেতে চেয়েছে বা পেরেছে। এ কথা ঠিক, বহমান বর্তমান বিশ্বে ক্রমশ, অর্থনীতিই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের পথে নিয়ে যাচ্ছে। কেননা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন থেকে শুরু করে, সব পর্যায়ে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-বিনোদনসহ সব কিছুতেই নীতিনির্ধারণে অর্থ নিয়ামক ভূমিকায়। সিদ্ধান্ত হয় আর্থিক প্রভাব, সক্ষম সম্ভাবনার নিরীখে।
রাজনীতি নীতিনির্ধারণ করে অর্থনৈতিক জীবনযাপনকে। একইসঙ্গে রাজনীতি জবাবদিহি, সুশৃঙ্খল, সুশোভন, সুবিন্যস্ত করবে এটা ঠিক। কিন্তু নীতিনির্ধারক যদি ভক্ষক হয়ে নিজেই অর্থনৈতিক টানাপড়েন সৃষ্টির কারণ হয়, তখন আমজনতার অর্থনৈতিক জীবনযাপন পোষিত হওয়ার পরিবর্তে যদি নিজস্ব তাগিদে ও প্রয়োজনে নিজস্ব উপায়ে সংগ্রহে ব্যাপৃত হতে হয় তখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের এখতিয়ার ও ক্ষমতা খর্ব হয়।
আইনসভায় নীতিনির্ধারক বিধিবিধান তৈরি করবেন সবার জন্য, নিরপেক্ষভাবে, দূরদর্শী অবয়বে। কিন্তু সেই আইন প্রয়োগে নীতিনির্ধারক নিজেই নিজের স্বার্থ অধিকমাত্রায় দেখতে থাকেন দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। যখন নীতিনির্ধারক প্রতিপক্ষ বিরুদ্ধবাদীদের বঞ্চিত করতে স্বেচ্ছাচারী অবস্থান গ্রহণ করেন, তখন ওই আইন প্রয়োগের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয়-সন্দেহ তৈরি হয়। এই অবস্থায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আমজনতার দৃষ্টিভঙ্গি হয় নেতিবাচক। এক সময় রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিই তারা আস্থা হারিয়ে ফেলেন।
দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে কর্মসূচি পরিপালিত হবে দলমত নিরপেক্ষভাবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুযোগ-সুবিধা অধিকার আদান-প্রদান, নীতি নিয়মকানুন, আইনশৃঙ্খলার বিধানাবলি বলবৎ, প্রয়োগ ও বাস্তবায়িত হবে এটাই সাংবিধানিক সত্য ও প্রথা। কিন্তু যদি দেখা যায়, ক্ষমতাসীন নীতিনির্ধারক তা শুধু নিজের, নিজের এলাকা, গোত্র, দল ও কোটারির মধ্যে বরাদ্দ সীমিত করে ফেলে এবং বিরুদ্ধবাদীদের বঞ্চিত করায় মেতে ওঠে, তাহলে সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে পারে। এ ধরনের পরিবেশে রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে, নিয়ন্ত্রক ও নিয়ন্ত্রিতের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি উৎপাদনে সম্পদে সংসার সমাজসহ নীতিনির্ধারককেও একটি রূপময়, বেগবান, ঐশ্বর্যমণ্ডিত ও আনন্দঘন সক্ষমতা দান নির্মাণ করবে। কিন্তু রাজনৈতিক নীতিনির্ধারক যদি ভালো পদক্ষেপের দ্বারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনাকে, সমৃদ্ধির সক্ষমতা ও সুযোগকে প্রশ্নবিদ্ধ-পক্ষপাতযুক্ত, দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলে তাহলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিবেশ হয় বিপন্ন। ফলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা শুধু দ্বিধাগ্রস্ত নয়, হয় বাধাপ্রাপ্তও।
গণতন্ত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নের রূপকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার থাকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের। নির্বাচনি ইশতিহারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচির নানান প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে রাজনৈতিক দল। ভোটারকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, ক্ষমতায় গেলে এ জাতীয় উন্নয়নের বন্যায় ভেসে যাবে দেশ। কিন্তু নেতৃত্ব তা যদি যথাযথ বাস্তবায়ন করতে না পারে, তাহলে ব্যর্থতার অভিযোগের তীর নিক্ষিপ্ত হয় খোদ রাজনীতিরই নেতিবাচকতার দিকে। অতীতে রাজা-বাদশাহদের রাজনীতি আবর্তিত হতো মসনদে আরোহণকে কেন্দ্র করে। সে সময় প্রাসাদ ষড়যন্ত্র হতো সেভাবেই। মসনদ আরোহণের মুখ্য প্রেরণা ও শক্তির উৎস থাকত অর্থ প্রতিপত্তি উদ্ধার ও অধিকার।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নির্বাচিত-অনির্বাচিত মিলে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সরকার নেতৃত্বে এসেছে। প্রত্যেকের কিছু না কিছু অবদানে বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ এ পর্যায়ে পৌঁছেছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীদের সংখ্যা কমছে, দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে বা হচ্ছে। শিশুমৃত্যুর হার কমেছে, মানুষের মাথাপিছু আয়ের উন্নতি সাধিত হয়েছে। বাজেটের বপু বেড়েছে, এডিপির আকার বেড়েছে। এখানে স্বভাবতই প্রশ্ন এসেছে, অর্থনৈতিক এ উন্নয়নে সরকারগুলোর একক কৃতিত্ব কতখানি? এসব সাফল্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের সৃজনশীলতা, নির্ভরযোগ্যতা, সততা স্বচ্ছতা জবাবদিহিতার কারণে বেড়েছে, নাকি দেশের অভ্যন্তরস্থ অর্থনীতির স্বয়ংক্রিয় স্বচ্ছ সলিলা শক্তির বলে এটি বেড়েছে?
পাশাপাশি এটাও দেখার বিষয়, পরিস্থিতি এমন হয়েছে কিনা আমজনতার নিজস্ব উদ্ভাবন প্রয়াসে অর্জিত সাফল্য বরং নীতিনির্ধারকের নিজেদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি, ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের দ্বারা বরং বাঞ্ছিত উন্নয়ন অভিযাত্রা বাধাগ্রস্ত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা?
নাগরিকের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন প্রয়াসে ক্ষমতালোভী দুর্নীতিদগ্ধ রাজনৈতিক কর্মসূচি বাধা সৃষ্টি করেছে কি না, কিংবা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়ে নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও সেবাপ্রাপ্তি বাধাপ্রাপ্ত করছে কি না?
বাংলাদেশে যথাপরিমাণ ন্যায্য কর রাজস্ব অর্জিত হলে, ঘাটতি বাজেট হয় না এবং উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশের কাছে হাত পাততে হয় না। গভীর অভিনিবেশ সহকারে বিচার বিশ্লেষণের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় কেন ন্যায্য কর রাজস্ব আহরিত হয় না বা হচ্ছে না? কারা করনেটের বাইরে এবং তাদের কর নেটের আনার পথে প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যা কোথায়? এখনো টেক্স খাতে চরম দুর্নীতির স্বেতপত্র দেখতে পাওয়া যায়। দুর্নীতিগ্রস্ত কর কর্মকর্তারা কোটি কোটি টাকা দুর্নীতির জন্য টেক্স খাতকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যার প্রমাণ গত এক সপ্তাহের চট্টগ্রামের সংবাদপত্র।
এসবের কৌনিক দৃষ্টিতে পরীক্ষা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশ সমাজ ও প্রশাসন কর রাজস্ব সুষমকরণের পথে স্বচ্ছতার ন্যায়ানুগতার, পক্ষপাতহীন পদক্ষেপ নিতে অপারগ হয়েছে বা হচ্ছে। অথবা কর প্রদানে রেয়াত বা অব্যাহতি প্রাপ্তিতে অন্তর্নিহিত অপারগতা বা দুর্বলতা রয়েছে। সাধারণ ও অসাধারণ করদাতায় বিভক্ত সমাজে অসাধারণ করদাতারা এক দাগে যখন কর ফাঁকি দেয়, সাধারণ করদাতার ওপর তার চাপ পড়ে। বড় করদাতারা নীতিনির্ধারকের প্রশ্রয়ে পার পেয়ে গেলে, কর প্রদান ও আহরণের সংস্কৃতি সুস্থ ও সাবলীল হতে পারে না। আইন প্রণেতাদের সিংহভাগ অংশ বৃহৎ করদাতা হলে ক্ষমতার বলয়ে বসবাসকারী হিসেবে রেয়াত ও ছাড় গ্রহণের মাধ্যমে ব্যাপক কর রাজস্ব রাষ্ট্রের হাতছাড়া হয়ে যায়। যথাযথ কর রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা হয় না। অথবা কথাটি এভাবে ঘুরিয়ে বলা যায় নীতিনির্ধারক নেতৃত্বের যে বলিষ্ঠ কমিটমেন্ট দরকার কর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যে, যে সুষম পরিবেশ, যে পক্ষপাতহীন আচরণ, যে দৃঢ়চিত্ত মনোভাবের প্রয়োজন যেন থেকেও থাকে না।
আইনসভায় যে অর্থবিল উত্থাপিত ও গৃহীত হয়, সেখানে ছাঁটাই প্রস্তাব পেশের কিংবা বিভিন্ন গঠনমূলক মত প্রকাশ বা প্রস্তাবনা পেশের উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যবস্থায় বেশ সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে রাজনীতি অর্থনীতি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভালো অবস্থানে নেই। দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতির সেক্টরে সাম্প্রতিক সময়ে অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। ঢাকা চট্টগ্রাম দেশের আরো অন্যান্য অঞ্চলে অর্থনীতির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের বাতাস দেখা যাচ্ছে। রাজনীতির বক্তব্যেও বিভাজনের দ্বন্দ্ব ও অনৈক্যের বক্তব্য জোরালো হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতি ও রাজনীতির মধ্যে সুখকর সংবাদ নেই বলা চলে। এ মুহূর্তে রাজনীতি ও অর্থনীতির বিশ্লেষকদের অভিমত এ দুই বিষয়ে জাতীয় ভাবে ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে দেশ জাতির জন্য ক্ষতি ছাড়া অগ্রগতির সম্ভাবনা নেই।
লেখক : সংগঠক, গবেষক, কলামিস্ট
কেকে/এজে