মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫,
১২ কার্তিক ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫
শিরোনাম: প্রার্থী বাছাইয়ে কৌশলী বিএনপি      অর্থনীতিতে গতি ফেরানোয় চ্যালেঞ্জ      বড় নাশকতার পাঁয়তারা      হার দিয়ে টি-টোয়েন্টি সিরিজ শুরু বাংলাদেশের      দেশের বাজারে আবারও কমলো স্বর্ণের দাম      ঐকমত্য কমিশনের শেষ বৈঠক, মঙ্গলবার সুপারিশ পেশ      মঙ্গলবার সন্ধ্যায় উপকূলে আঘাত হানবে ঘূর্ণিঝড় মোন্থা      
খোলা মত ও সম্পাদকীয়
ডিপফেক কি আসলেই আমাদের জন্য একটি দুশ্চিন্তার কারণ?
প্রফেসর ড. শাহ জে মিয়া
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৫, ৭:১২ পিএম
ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

আজকের আলোচনায় আমরা একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক ব্যাপার নিয়ে কথা বলব। ইদানীং ডিপফেক এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক অপ্রীতিকর ছবি এবং ভিডিওতে ইন্টারনেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা কিনা বেশকিছু ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সম্মানহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ আলোচনা শুরু করার আগে আসুন জেনে আসা যাক, এই বহুল আলোচিত এবং সমালোচিত বিষয় ডিপফেক (Deepfake) কী, এটি কীভাবে কাজ করে এবং এর ক্ষতিকর প্রভাবগুলো কী কী। 

ডিপফেক হলো একটি ডিজিটালি তৈরি করা মিডিয়া ফাইল, যেমন একটি ছবি, ভিডিও বা অডিও রেকর্ডিং, যা দেখতে আসল বলে মনে হলেও আসলে এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি এবং যার কোনো সত্যতা নেই। ডিপফেক এপ্লিকেশনের এ নতুন ধারণাটি ডিজিটাল ব্যবসার জগতে ব্যবহারযোগ্য হলেও বিশ্বব্যাপী বেশির ভাগ সমাজেই এটি বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ডিপফেক কন্টেন্ট যেগুলো সাধারণত ছবি, ভিডিও অথবা অডিও হয়ে থাকে তা তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ডিপফেক সফটওয়্যারগুলো খুবই ইন্টারেস্টিংভাবে কাজ করে থাকে। 

সফটওয়্যারগুলো এতটাই উন্নত যে, একজন ব্যবহারকারী যদি দুজন ভিন্ন ব্যক্তির ছবি সফটওয়্যারটিকে দিয়ে বলে যে, আমাকে একটি ছবি তৈরি করে দেও যেখানে দেখা যাবে এ দুজন ব্যক্তি নিজেদের মধ্যে হাত মেলাচ্ছে, তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সফটওয়্যারটি এত নিখুঁত একটি ছবি তৈরি করে দেবে, যেটা থেকে বোঝার কোনো উপায়ই থাকবে না যে, এ ঘটনাটি কখনোই ঘটেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ ডিপফেক প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে এবং সফটওয়্যারগুলো শক্তিশালী হয়েছে। এখন সফটওয়্যারগুলো কৃত্রিম ছবি তৈরির সঙ্গে সঙ্গে এমন ভিডিও তৈরি করতে পারবে, যেখানে দেখা যাবে আমাদের এ উদাহরণের দুজন মানুষ একসঙ্গে বসে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে আলোচনা করছে, চা পান করছে বা একসঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে যদি সফটওয়্যারগুলোকে এ দুজন ব্যক্তির কোনো কথা বা বক্তব্য প্রদান করা যায় তাহলে এগুলো তাদের কণ্ঠস্বর নকল করে যে কোনো বক্তব্য ভিডিওর সঙ্গে জুড়ে দিতে পারবে।  ভিডিওতে তাদের প্রতিটি বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে সঠিকভাবে মুখের পেশি নড়বে এবং আবেগের পরিবর্তন হবে। এ মিথ্যা ভিডিও যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে খালি চোখে দেখে কেউই এ ছবি বা ভিডিওর কৃত্রিমতা যাচাই করতে পারবে না। 

বর্তমানে আমাদের দেশে শহরে, গ্রামে-গঞ্জে প্রায় সবাই বলতে গেলে দৈনিক সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে থাকেন। আমাদের মধ্যে অনেকেরই ডিপফেক সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। আমরা খুব সহজেই সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি ছবি বা ভিডিও দেখে তাকে সত্য মনে করে থাকি।  যাচাই-বাছাই ছাড়াই অন্যদের সঙ্গে এটি নিয়ে আলোচনা করি এবং মুহূর্তের মধ্যেই এ মিডিয়াটি দেশব্যাপী ‘ভাইরাল’ হয়ে যাচ্ছে। এরকম হাজারো উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে, যেখানে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা রাজনৈতিক ব্যক্তির একটি স্পর্শকাতর বক্তব্য অনলাইনে বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘ভাইরাল’ হয়েছে, যা কিনা বেশ কিছুদিনের মধ্যেই প্রমাণিত হয় যে এটি কোনোমতেই সত্য খবর ছিল না। বরং এটি ছিল ডিপফেক দিয়ে তৈরি একটি মিথ্যা বা বানোয়াট অপপ্রচার।  কিন্তু এর মধ্যেই সেই ব্যক্তির যা সামাজিক ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। 

খুব শিগগির, মাত্র তিন মাসের মধ্যেই আমাদের মাঝে সংগঠিত হতে চলেছে জাতীয় নির্বাচন ২০২৬। এ মুহূর্তে প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যক্তির জন্য তাদের ইমেজ ধরে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক এ মুহূর্তেই একটি বিরোধী শক্তি তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা এবং ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের ইমেজ, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করার। এবং তাদের ব্যবহৃত অস্ত্রগুলোর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপ্রীতিকর মিডিয়া বা কনটেন্ট তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়া। এ ক্রান্তিকালীন তাই ডিপফেক সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন, এর কার্যপ্রণালী সম্পর্কে জানা এবং এর বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক প্রচারণা করা প্রতিটি সরকারি, বেসরকারি এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের জন্য অতীব জরুরি। 

এখানে বলে রাখা ভালো যে, ডিপফেক শব্দটি প্রথম ২০১৭ সালের শেষের দিকে একজন Reddit ব্যবহারকারী দ্বারা অনলাইন জগতে প্রবর্তিত হয়েছিল। এটির মূল উদ্দেশ্য হলো একটি চিত্র বা ভিডিওতে একজন ব্যক্তির সাদৃশ্য অন্য ব্যক্তির সঙ্গে অদলবদল করানো। ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো কন্টেন্ট বিনোদন এবং সৃজনশীলতার জন্য তৈরি করা যেতে পারে। তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, এটি উল্লেখযোগ্য নৈতিক দ্বন্দ্ব ও উদ্বেগও উত্থাপন করতে পারে। বিশেষ করে, যখন জনসাধারণের কাছে ভুল তথ্য বা নেতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। এ কারণেই গবেষকরা ডিজিটাল কন্টেন্ট ব্যবহারের সময় সর্বদা সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন। এর মানে হচ্ছে, এখন এবং সব সময় যা ডিজিটাল কন্টেন্টে দেখা যায় বা দেখা হয়, তা বিশ্বাসযোগ্য নাও হতে পারে।  

ডিপফেক ব্যবহার করে মানুষ এমন কিছু করতে পারে যা শুধু ব্যবসা ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর তা নয়, এগুলো শিশুদের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে। যেহেতু এসব সফটওয়্যারগুলো খুবই সহজলভ্য এবং মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে কম্পিউটার সফটওয়্যার হিসেবেও এগুলো পাওয়া যাচ্ছে, তাই দেখা যায় যে, স্কুলের শিক্ষার্থীরাও এখন ডিপফেক ব্যবহার করে তাদের সহপাঠীদের অপ্রীতিকর মিডিয়া তৈরি করে নিজেদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা ভুক্তভোগী শিশু-কিশোরদের জন্য মানহানিকর, অপমানজনক এবং তাদের মানসিকভাবে অনেক বিপর্যস্ত করে ফেলছে। এসব হীন আনন্দের প্রতিক্রিয়া হিসেবে মাঝে মাঝেই দেখা যায়, ভুক্তভোগী শিশু-কিশোররা মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে নিজেদের ক্ষতি করে ফেলে। এসব ঘটনা শিক্ষার অন্তরায়, সামাজিক নৈতিকতা এবং সত্যতা ও বিশ্বাসের জন্য ক্ষতিকর। ডিপফেক প্রযুক্তির প্রভাব এবং জাল কন্টেন্ট তৈরির কারণে, আমাদের সমাজে এক ধরনের হ্যালুসিনেশন তৈরি হয়, যেখানে মানুষ সত্য ও মিথ্যার তফাৎ করতে পারে না। হ্যালুসিনেশন বলতে এমন প্রতিক্রিয়া বা আউটপুট তৈরি করাকে বোঝায় যা অর্থহীন, বাস্তবিকভাবে ভুল, কিন্তু দেখতে সত্যের মতো মনে হয়।

আগেই আলোচনা করেছিলাম যে, ডিপফেক একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অ্যাপ্লিকেশন, যা কৃত্রিম মিডিয়া কনটেন্ট তৈরি করে থাকে। ডিপফেক সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য একটি মন্তব্য এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। এরিক এন্ডারসন নামের একজন বিজ্ঞানী বলেছেন, ডিপফেকের পেছনের মনোবিজ্ঞানের ধারণাটি হচ্ছে যে, ‘আমরা যা দেখি, আমাদের মন বা মস্তিষ্ক তাই বিশ্বাস করে বা বিশ্বাস করতে চায়’, যেটা কিনা ডিপফেকের অত্যন্ত শক্তিশালী একটি মারণাস্ত্র। এখন দেখা যাক ডিপফেক প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে। প্রথমে, এতে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা এর বৃহৎ ভাষা মডেলগুলোকে প্রশিক্ষণ করার কাজটি সম্পন্ন হয়। বৃহৎ ভাষা মডেলগুলোকে লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলও বলা হয়। যা কিনা জেনেরেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আলগোরিদমিক একক। এখানে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কৌশলগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তাকে ডিপ লার্নিং মডেল বলা হয়। এ মডেলটি সাধারণত এক বা একাধিক নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে, যার লক্ষ্য হলো হাজার হাজার মানব বস্তুর ছবি এবং ভিডিওর মাধ্যমে প্রশিক্ষিত হওয়া বা শিক্ষা গ্রহণ করা। 

এখানে বলে রাখা ভালো যে, আমরা অনলাইন জগতে বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে আমাদের যেসব আমাদের ছবি বা ভিডিও পোস্ট করে থাকি সেখান থেকে আমাদের চেহারা, আমাদের কণ্ঠস্বর, আমাদের গতিবিধি এবং আমাদের কনটেন্টকে এসব মডেলগুলোর জন্য প্রশিক্ষণ ডেটা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ডেটা থেকে শিক্ষা গ্রহণই পরে অনেক নতুন নতুন মিডিয়ার আবির্ভাব ঘটায়, যেগুলো দেখতে আমাদের মতো, কণ্ঠস্বর শুনতে আমাদের মতো কিন্তু মূলত এগুলো কৃত্তিম মিডিয়া, যেগুলোর সঙ্গে আসল ব্যক্তির কোনো সম্পর্কই নেই। এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেলগুলো মানুষের মুখের নড়াচড়া, অভিব্যক্তি এবং ভয়েস প্যাটার্ন বা সংশ্লেষণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে হুবহু নকল করতে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। ভয়েস সংশ্লেষণ বা কণ্ঠস্বরের ধরন বলতে একজন ব্যক্তির কথা বলার অনন্য ধরনকে বোঝায়। প্রতিটি ব্যক্তির কথা বলার ছন্দ, স্বর, গতি এবং বিরতির মতো বৈশিষ্ট্যগুলো অন্যের থেকে আলাদা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে এ আলাদা বৈশিষ্ট্যগুলোকে চিহ্নিত করা যায় এবং সেগুলো অনুকরণ করে নির্দিষ্ট ব্যক্তির কণ্ঠস্বরে কোনো বক্তব্যও তৈরি করা সম্ভব।

দ্বিতীয় কার্যকলাপটি মানুষের চেহারার পরিবর্তন বা ফেস সোয়াপিং বা মুখ-অবয়ব বিকৃতিকরণ এর সঙ্গে সম্পর্কিত। এ কার্যকলাপটিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেলকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয়। এ প্রশিক্ষিত ডিপফেকের কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা মডেলটি একটি ভিডিও বা ছবিতে মানুষের মুখের বদলে অন্য একটি বা যে কোনো কিছুর সমন্বয় দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারে। কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা মডেলটি মানুষের মুখের বৈশিষ্ট্য, ত্বকের রং, টোন এবং আলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রাখতে প্রশিক্ষিত হয়, যাতে মুখ অদলবদলের ঘটনাটি নির্বিঘ্ন এবং পরিচ্ছন্ন হয়। যেমন কোনো ডিপফেক ভিডিও তৈরি করার সময় নকল বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে মুখের কোনো অভিব্যক্তি বা অনুভূতির মিল রাখতে হলে এ মডেলগুলো তাদের প্রশিক্ষণ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে কাজে লাগে। এরপর, এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাটি মুখের নড়াচড়া বা মুভমেন্ট সেটআপের জন্য কাজ শুরু করে, যাতে নকল মুখ স্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করে, অভিব্যক্তি ও মাথার নড়াচড়া এবং এমনকি সূক্ষ্ম পেশির টান মূল ভিডিওর সঙ্গে গতির সমন্বয় করে থাকে।

এরপর ডিপফেকের পদ্ধতির মধ্যে ভয়েস সংশ্লেষণ কার্যকলাপ পরিচালিত হয়। যেখানে জাল ভিডিও বা চিত্র তৈরি করতে সংশ্লেষিত বা পরিবর্তিত ভয়েস অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে সম্পর্কিত ব্যক্তির বা মানুষের স্বর এবং কথা বলার ধরন অনুকরণ করা। পরিশেষে, যে কোনো বিকৃতি সংশোধন এবং দর্শকদের কাছে ডিপফেক কনটেন্টটিকে বিশ্বাসযোগ্য, খাঁটি এবং নির্ভরযোগ্য দেখাতে যা যা করা দরকার, এটি তাই করে থাকে।

ডিপফেকের তথ্য ব্যবহার করে মানুষ এমন কিছু করতে পারে, যা ব্যবসা ও মানুষের বা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। শিশুদের শিক্ষার অন্তরায়, সামাজিক নৈতিকতা এবং সত্যতা ও বিশ্বাসের জন্য হানিকর। আগেই বলেছিলাম যে, ডিপফেক প্রযুক্তির প্রভাব এবং জাল কনটেন্ট তৈরির কারণে আমাদের সমাজে এক ধরনের হ্যালুসিনেশন তৈরি হয়, যা মানুষের মধ্যে যে কোনো বিষয় সম্পর্কে ভুল ধারণা ছড়িয়ে দিতে পারে। যার বস্তুত কোনো বাস্তবতা নেই অথবা যদি থেকেও থাকে তবে তা যে কোনো সময় যে কোনো মাধ্যমে জাল ছবি বা জাল ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে অসত্য চিন্তাভাবনা তৈরি করতে পারে।

এখন এ ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতিরোধ করার কি কোনো উপায় নেই? অস্ট্রেলিয়ায় ই-সেফটি নামের এমন একটি উদ্যোগ পরিচালনা করা হয়, যার মধ্যে অপব্যবহার বা বিভ্রান্তির জন্য ব্যবহৃত ডিপফেক কনটেন্টও অন্তর্ভুক্ত। ই-সেফটির আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের ডিজিটাল কনটেন্ট সুরক্ষা রাখা এবং নিরাপদ অনলাইন অনুশীলন করার বিষয়ে অনুপ্রেরণা দেওয়া। অস্ট্রেলিয়ায় অনেক ক্ষেত্রে ডিপফেক কনটেন্ট সম্পর্কে নির্দেশনা খুঁজতে সাধারণ জনগণ, শিক্ষাবিদ এবং সাংবাদিকরা ই-সেফটির সংস্থানগুলোকে ব্যবহার করে থাকেন। ই-সেফটি কমিশনার ডিপফেকের প্রতিক্রিয়া উন্নত করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানি, সরকারি কর্মকর্তা এবং গবেষকদের (সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা) সঙ্গেও কাজ করে। এ তথ্যগুলো ই-সেফটি কমিশনার ইনিশিয়েটিভ ওয়েবসাইটের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি, যা গুগলের মাধ্যমে যে কোনো সময় ওপেন সোর্স হিসাবে পাওয়া যেতে পারে।

বিভিন্ন অনলাইন উৎসের মাধ্যমে, ডিপফেক ল্যাবটি আসলে কী, আসুন জেনে আসা যাক। ডিপফেক ল্যাব একটি সফটওয়্যার স্যুট তৈরি করে, যা ভিডিও এবং ছবির মতো বাস্তবসম্মত মুখ বা চিত্রের বস্তুর অদলবদলের কাজ চিহ্নিত বা এর ধরন আবিষ্কার করতে পারে। অনেক গবেষক বিভিন্ন ডিপফেক ল্যাব প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছেন, যা বিনামূল্যে পাওয়া যায় এবং গিটহাব, টরেন্ট এবং মেগা সহ বিভিন্ন উৎস (free online platforms) থেকে ডাউনলোড করা যায়। আগ্রহী যে কোনো ব্যবহারকারী বা ব্যবহারকারীরা, যারা ডিপফেক সম্পর্কে নতুন কিছু জানতে চান, তারা ডিপফেক ল্যাব সম্প্রদায়ের প্রদত্ত টিউটোরিয়াল এবং গাইডের মাধ্যমে দ্রুত ডিপফেক চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়াটি শিখতে পারেন।

অস্ট্রেলিয়ার আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীদারত্বের একটি উদ্যোগের (যেই উদ্যোগটির মাধ্যমে ডিপফেক দ্বারা তৈরি ভুয়া খবর শনাক্ত করা হয়) উদ্যোগের অনুকরণ করে, সিএসআইআরও ডিপফেক ডিটেকশন রিসার্চ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ডিপফেক কনটেন্ট শনাক্তকরণের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য গবেষণা পরিচালনা করে। সিএসআইআরও (দক্ষিণ কোরিয়ার একেকেইইউ-এর সহযোগিতায়) পাঁচটি পদক্ষেপের একটি মূল্যায়ন কাঠামো প্রস্তাব করেছে, যেখানে ডিটেক্টরগুলো কোথায় ব্যর্থ হয় এবং কীভাবে সেগুলোকে শক্তিশালী করা যায় তা চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। সিএসআইআরও-এর অগ্রগতি বিশ্বব্যাপী গবেষণা সম্প্রদায় এবং প্রযুক্তি শিল্পের সঙ্গে উন্মুক্ত করা হচ্ছে। এ রকম আরেকটি উদ্যোগ হলো, অস্ট্রেলিয়ার টরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণা ও অপ্টিমাইজেশন (এআইআরও) কেন্দ্র—এআইআরও, যেখানে ডিপফেক শনাক্তকরণ কৌশলগুলোর অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য নিবেদিত একটি একাডেমিক ডিপফেক প্রকল্প চালু আছে। এআইআরও টিম ভিডিওগুলোতে ডিপফেক ম্যানিপুলেশনের সূক্ষ্ম লক্ষণগুলো ধরার জন্য তৈরি অত্যাধুনিক মেশিন লার্নিং মডেল ব্যবহার করছে। যাই হোক, বর্তমানে সাইবার স্পেসে ডিপফেক এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য মোকাবিলায় এবং এর ভয়ংকর ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সক্ষম সফ্টওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন আছে। যেগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে, ডিপফেক কনটেন্টগুলোকে শনাক্ত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। 

যদি বিএনপি দেশ পরিচালনার সুযোগ পায়, ডিপফেকসহ আরো অন্যান্য সৃজনশীল যেসব এআই সম্পর্কিত টেকনোলজি আছে, এগুলো ব্যবহার করে কীভাবে বিশ্ববাজারে মানুষের কর্মসংস্থান করা যায়, কীভাবে তরুণদের তাদের নিজেদের পেশা তৈরি করে দেওয়া, উদ্যোক্তা হতে তাদের কীভাবে নিয়োজিত করা যায় এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করব। বিএনপির ৩১ দফার ৩০তম দফাটি এসব কাজের এবং কাজের প্রক্রিয়ায় সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা তরুণ সমাজকে কীভাবে ইতিবাচক রাস্তায় তাদের সহযোগিতা করা, তাদের জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য যা যা করা দরকার, তা করব। এসব অ্যাপ্লিকেশন এখন আর নেতিবাচক কিছু নয়। এদের ব্যবহার কীভাবে নেতিবাচক থেকে ইতিবাচক করা যায়, যদি নেতিবাচক কিছু তৈরি করে, সেগুলোর জন্য প্রতিষেধক বা প্রতিরোধক এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করার জন্য আমরা তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষা দেব, যাতে তারা এই এআই ব্যবহার করেই আবার ফেক নিউজ বা কনটেন্ট খুঁজে বের করতে পারে বা প্রতিরোধ করতে পারে। এর মাধ্যমে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং পৃথিবীর বুকে তরুণ সমাজকে এ বুদ্ধিবৃত্তিক যে সমাজব্যবস্থা তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করার যে ক্ষমতা এগুলো বৃদ্ধি করা হবে আমাদের অন্যতম দায়িত্ব এবং এ দায়িত্বের অংশ হিসেবে সরকারি বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং, কর্মশালা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের শর্ট কোর্স এবং কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে তাদের শিক্ষা দেওয়া খুবই অন্যতম এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এটার মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলব ইনশাআল্লাহ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে। তরুণ প্রজন্মকে আমরা উচ্চতর প্রযুক্তিগত জ্ঞান প্রদানের মাধ্যমে একত্রিত করতে পারব এ উপায়ে বলে আমি মনে করি। আজকে নিবন্ধটি এখানেই শেষ করছি। আবারো অন্য কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি সম্পর্কিত লেখা নিয়ে সামনে আসব। সবাইকে ধন্যবাদ।  

লেখক : প্রফেসর অফ বিজনেস এনালিটিক্স,
উপপরিচালক, সেন্টার ফর অ্যাপ্লাইড এন্ড রেস্পন্সিবল এআই,
 নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া

কেকে/এজে
আরও সংবাদ   বিষয়:  ডিপফেক   Deepfake   এআই   AI  
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

যেখানে উন্নয়নের গল্পে ঝরে পড়ে মানুষের জীবন
ফরিদপুরে শ্রীশ্রী কাত্যায়নী পূজা শুরু
প্রার্থী বাছাইয়ে কৌশলী বিএনপি
যুবনেতৃত্বাধীন পরিবেশবান্ধব এডভোকেসি ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠিত
অর্থনীতিতে গতি ফেরানোয় চ্যালেঞ্জ

সর্বাধিক পঠিত

বাঞ্ছারামপুরে স্কুল কমিটির নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ, বিতর্কে প্রধান শিক্ষক ছিদ্দিকুর
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ছয় লেনের দাবিতে লোহাগাড়ায় গণসংযোগ
বাঘায় চর দখলকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, প্রাণ গেল ‍দুইজনের
গৌরনদীতে ডেঙ্গুতে গৃহবধূর মৃত্যু, নার্সদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ
গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সুপ্রিম সিড কোম্পানির চুক্তি

খোলা মত ও সম্পাদকীয়- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close