বাংলাদেশের অর্থনীতি এক অনিশ্চয়তার জালে আটকে আছে। ব্যবসা-বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, এমনকি আন্তর্জাতিক ঋণচুক্তিও এখন রাজনৈতিক আস্থার অপেক্ষায়। সময় যত যাচ্ছে, একটি নির্বাচিত ও দায়বদ্ধ সরকারের দাবি ততই জোরালো হয়ে উঠছে। ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা বলছেন, নির্বাচিত সরকারের অনুপস্থিতি শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিকভাবেও দেশকে স্থবির করে রেখেছে।
আইএমএফ ইতোমধ্যেই স্পষ্ট করে জানিয়েছে, নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত তারা ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের পরবর্তী ঋণকিস্তি ছাড় করবে না। এটি নিছক অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক আস্থার প্রশ্নও বটে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নতুন প্রকল্প স্থগিত রেখেছেন, দেশি উদ্যোক্তারা পুরোনো ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছেন। ফলে নতুন উদ্যোগ বা কর্মসংস্থান কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।
আবাসন ও উৎপাদন খাত থেকে শুরু করে তৈরি পোশাক শিল্প—সব ক্ষেত্রেই বিনিয়োগের গতি কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে ২২ শতাংশ। এমনকি অনেকে বিদেশে সম্পদ স্থানান্তর করছেন—যা অর্থনীতির জন্য এক অশনিসংকেত।
অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি সরকারের নীতি পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও পূর্বানুমানযোগ্যতার ঘাটতিও অর্থনীতিকে দুর্বল করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য বলছে, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ঐতিহাসিকভাবে নিম্ন ৬.৩৫ শতাংশে। ফলে শিল্প সম্প্রসারণ, নতুন কর্মসংস্থান ও উৎপাদন সবই থমকে আছে। অন্যদিকে সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে বেশি, যা বেসরকারি খাতের জন্য অর্থের জোগান সংকুচিত করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সীমিত মেয়াদ ও ম্যান্ডেটের কারণে নীতিগত সিদ্ধান্তে সাহসী পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। বিজিএমইএ, রিহ্যাব, এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন সবারই একই কথা ‘এখন ঝুঁকি নেওয়ার সময় নয়।’ তাদের মতে, বিনিয়োগের মূল শর্ত হলো আস্থা, আর সেই আস্থা আসে কেবল নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে কোনো বড় অর্থনৈতিক পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা নেই। নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি আরো জটিল হতে পারে বলে বিশিষ্টজনরা মনে করেন। সরকার কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলেও আর্থনীতির টেকসই স্থিতিশীলতার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অচলায়তন ভাঙতে পারে কেবল একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। এ স্থবিরতা কাটাতে হলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন রাজনৈতিক আস্থা পুনর্গঠন। নির্বাচনের সময়সূচি ও প্রক্রিয়া নিয়ে দ্রুত স্পষ্টতা আনতে হবে, যাতে ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও উন্নয়ন সহযোগীরা নিশ্চিন্ত হন। সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে আস্থা ফিরিয়ে আনা, অর্থনৈতিক নীতিতে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা, জ্বালানি ও আইনশৃঙ্খলা খাতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং বেসরকারি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা। কারণ নাজুক অর্থনীতি আমাদের একটি নাজুক রাষ্ট্রকাঠামোর দিকেই নিয়ে যাবে।
কেকে/এজে