বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসন্ন ২০২৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানান নাটকীয়তা, রাজনৈতিক উত্তেজনা, চরম অনিশ্চয়তা ও সমঝোতা জটিলতার এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। ২০২৪ এর গন অভ্যুত্থানে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের পতন পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচন কেবল একটি নিয়মিত রাজনৈতিক আয়োজন নয়; এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তির জন্য এক বড় পরীক্ষা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিএনপি নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে একটি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের পাশাপাশি প্রশাসনকে জামায়াতে ইসলামীর আজ্ঞাবহ অবস্থান থেকে বিরত থাকার জোর দাবি জানিয়েছে। তারা ৩৬ দফা প্রস্তাব দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, প্রশাসনকে কমিশনের নিয়ন্ত্রণে আনা এবং নির্বাচনকালীন সহিংসতা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ। দলটি বলছে, অতীতের আওয়ামী লীগ সরকারের মতো কারচুপি, রাতের ভোট ও জাল ভোটের পুনরাবৃত্তি হলে জনগণের আস্থা পুরোপুরি নষ্ট হবে।
তবে ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই ছাত্র উপদেষ্টার বহাল থাকা এবং কয়েকজন উপদেষ্টার গৃহিত পদক্ষেপ বিএনপিকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহনমুলক নির্বাচনে তেমন আশ্বস্ত করতে পারেনি।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের দল হিসেবে বর্তমানে নিবন্ধন স্থগিত, তাদের প্রতীক বাতিল করা হয়েছে এবং দলটি এই সময় প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে বড় ধরনের সাংগঠনিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দলটি দাবি করছে, তাদের বাদ দিয়ে কোনো জাতীয় নির্বাচন অবাধ, আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহনযোগ্য ও সুষ্ঠু হতে পারে না। তবে ছাত্র আন্দোলন-পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন এখন তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এদিকে তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র জাতীয় পার্টি (জাপা) এখন রাজনৈতিকভাবে চরমভাবে কোণঠাসা অবস্থায় আছে। জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের আহ্বান জানালেও গন অধিকার এবং এনসিপির প্রেসারে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
এদিকে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি ইসলামি দল এক বৃহত্তর জোট গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও অতীতে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের নির্বাচনী জোট ছিল, ক্ষমতার ভাগাভাগি ছিল তবে বর্তমানে দুই দলের মধ্যে তীব্র আস্থাহীনতা ও ব্যাপক প্রতিযোগিতা মসঠের রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে। বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বের সম্পর্কের অবনতি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদেরকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে দাড় করিয়েছে। এমতাবস্থায় বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে আগামী নির্বাচনে জোট গঠনের সম্ভাবনা আপাতত নেই।
অন্যদিকে নবগঠিত এনসিপি সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিকভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনায় এসেছে। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে তাদের জনপ্রিয়তা ও ভোট কিছুটা বেড়েছে এবং বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে দেন দরবার ও আলোচনা চলছে। তবে ইদানীং প্রকাশ্যেই জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির সম্পর্কের অবনতি রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই তিন দলের (বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি) মধ্যে দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাস আসন্ন নির্বাচনে তাদের জুলাই অভ্যুত্থান সময়কালীন বন্ধন ও ঐক্যকে দুর্বল করছে এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্রদলকে মাঠে নামতে সুযোগ করে দিচ্ছে।
আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বামপন্থি দলগুলোও নিজেদের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টায় রয়েছে। সিপিবি ও বাসদ এর নেতৃত্বে একটি বৃহত্তর বাম গণতান্ত্রিক জোট গঠনের আলোচনা চলছে। তবে তাদের মধ্যেও ঐক্যের সংকট স্পষ্ট, কারণ কিছু দল বিএনপি জোট বা জামায়াতে ইসলামি জোটের সঙ্গে সমঝোতায় আগ্রহী।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইতিমধ্যেই সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “গণতন্ত্র রক্ষায় সব দলের আস্থা ও সহযোগিতা অপরিহার্য।”
বাংলাদেশের এই নির্বাচন নিঃসন্দেহে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে বিবেচিত হবে। একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য ও আস্থাহীনতা, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ও নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতির ঘাটতি—এই দুই বাস্তবতা মিলে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সাধারণ শান্তিপ্রিয় জনগনের নিকট অনিশ্চিত করে তুলেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ অবশ্য তাদের প্রতিক্রিয়ায় টক শো ও পত্রিকায় প্রকাশিত খোলা কলামগুলোতে সব দল অংশ না নিলে নির্বাচন উৎসবমুখর না হবার ও হানাহানির সম্ভাবনা আছে বলে আশংকা করছেন।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহনযোগ্য ও অংশগ্রহণমুলক না হলে গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের আস্থা বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা পুনরুদ্ধারের সুযোগ হারানোর আশঙ্কা থেকেই যাবে। অতএব, আসন্ন ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অস্তিত্ব ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাও নির্ধারণ করবে।
লেখক : ডীন ও চেয়ারম্যান, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
কেকে/ আরআই