বাংলাদেশের সাম্প্রতিক শিক্ষক আন্দোলনের দৃশ্যগুলো সংবাদপত্রের পাতায় যতটা স্পষ্ট, তার চেয়েও গভীরভাবে তা খচখচ করে উঠেছে জাতির বিবেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে শুরু করে জাতীয় প্রেস ক্লাব যেখানে-যেখানে রাজনীতির মিছিল দেখা গেছে সেখানেই আজ দেখা যাচ্ছে সাদা-কালো ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষকসমাজ।
কেউ মাথায় ব্যান্ডেজ, কেউ বা মাটিতে বসে নির্বিকার; কেউ বা আবার সন্তানের ছবি হাতে তুলে ধরেছেন ‘স্বীকৃতি চাই, দয়া নয়’। তাদের চোখে কান্না আছে, কিন্তু পরাজয় নেই। তারা জানেন তাদের আন্দোলন কেবল বেতন বাড়ানো নয়, বরং শিক্ষাব্যবস্থাকে মানবিক মর্যাদার আসনে ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম। কিন্তু আশ্চর্যজনক বৈপরীত্য হলো যার ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষক লড়ছেন সেই ছাত্র কি আদৌ জানে তার শিক্ষক রাজপথে? নাকি সে তখন ব্যস্ত ছিল কোনো ট্রেন্ডিং চ্যালেঞ্জে অংশ নিতে? রাস্তায় লাঠিচার্জের শব্দ যখন ভেসে আসছে, তখন ছাত্রের কানে বাজছিল হয়তো ভিএফএক্স-যুক্ত গেমের বিস্ফোরণ।
একদিকে শিক্ষক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ন্যায় চাইছেন, অন্যদিকে ছাত্র ডিজিটাল দুনিয়ায় ‘ভাইরাল’ হওয়ার নেশায় মত্ত। এ এক ট্র্যাজিক-কমেডি বাস্তবতা! আজকের বাস্তবতায় প্রশ্ন জাগে মনুষ্যত্ব গড়ার গুরু যদি রাস্তায় দাঁড়ান, আর শিষ্য যদি পর্দার আলোয় নিজেকে হারান, তবে সভ্যতার জাগরণ কোন পথে?
এই প্রশ্ন কেবল আবেগের নয়, এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রশ্ন, সমাজবিজ্ঞানের প্রশ্ন, এমনকি অর্থনীতিরও প্রশ্ন। কারণ যেখানে শিক্ষক অবমূল্যায়িত, সেখানে মানবসম্পদ কখনো টেকসই হয় না। আর, যেখানে ছাত্র আসক্ত, সেখানে সৃজনশীলতা কখনো প্রস্ফুটিত হয় না। সমস্যার মূলে আছে তিনটি বিচ্ছিন্ন বাস্তবতা
১. শিক্ষক নিজেকে আর ‘জাতির আলোকবাহক’ মনে করতে পারছেন না; বরং ‘অবহেলিত কর্মচারী’ মনে করছেন।
২.শিক্ষার্থী জ্ঞানের প্রতি মুগ্ধ নয়; বরং বিনোদনের অ্যালগরিদমের দাস হয়ে পড়েছে।
৩.রাষ্ট্র ও পরিবার উভয়েই শিক্ষা নিয়ে জরুরি সংকট উপলব্ধি করছে না; তারা ভেবেছে সময়ই সব ঠিক করে দেবে।
কিন্তু সময় যদি যথেষ্ট হতো, তবে আজ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ‘ডিজিটাল ডিটক্স ক্যাম্প’ চালু করত না। ফিনল্যান্ডে প্রতিটি স্কুলে বাধ্যতামূলক ‘মোবাইল ফ্রি আওয়ার’ চালু হয়েছে। জাপানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রদের ঘরে ইন্টারনেট ব্যবহারে সময়সীমা বাঁধা আছে। অথচ বাংলাদেশে একই বয়সের শিশুরা ‘গান বানাই’, ‘প্র্যাঙ্ক ভিডিও করি’, ‘রিয়েক্ট দিই’ এসবকে পেশা মনে করছে; অথচ তাদের কেউ শেখাচ্ছে না জ্ঞান অর্জনের আনন্দই সবচেয়ে বড় বিনোদন।
এখন করণীয় কী?
প্রথমত শিক্ষকের আন্দোলনকে কেবল সরকারি ফাইলে না রেখে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে। শিক্ষকের সম্মান নিশ্চিত না করে কোনো জাতি উন্নত হতে পারে না এ কথা পাঠ্যবইয়ের উদ্ধৃতি নয়, এটি বাস্তব ইতিহাস। কোরিয়ার উন্নয়নের পেছনে সবচেয়ে বেশি সম্মান পেয়েছেন শিক্ষক সমাজ।
মালয়েশিয়ায় শিক্ষককে ‘ন্যাশন হিরো’ হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়। বাংলাদেশে শিক্ষককে ‘অভিযুক্ত’ নয়, ‘প্রেরণাদাতা’ হিসেবে দেখতে হবে।
দ্বিতীয়ত শিক্ষার্থীদের জন্য স্পষ্ট ডিজিটাল নীতি গ্রহণ জরুরি। মোবাইল বন্ধ করলে হবে না, বরং মোবাইলকে ‘শিক্ষার টুল’ বানাতে হবে। গেমের মতো শিক্ষা-অ্যাপ, বিনোদনের মতো বিজ্ঞানভিত্তিক ভিডিও, মিমের মতো ব্যাকরণ শেখানো এভাবে শিক্ষা যখন বিনোদনের ফরম্যাটে আসবে তখন ছাত্র নিজেই মোবাইলকে ‘শিক্ষার হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করবে।
তৃতীয়ত পরিবারকে বুঝতে হবে, সন্তানের হাতে ফোন দেওয়ার আগে আদর্শ দেওয়া বাধ্যতামূলক। শুধু ‘ভালো ফলাফল করো’ না বলে বরং ‘ভালো মানুষ হও’ এই বার্তাটি প্রতিদিন পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে।
সর্বোপরি বলতে চাই, হাতে ব্যানার শিক্ষক, হাতে মোবাইল ছাত্র দৃশ্যটি যদি এভাবেই চলতে থাকে, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ইতিহাস মুখস্থ করলেও ইতিহাস তৈরি করতে পারবে না। দেশ তখন কেবল শ্রমিক উৎপাদন করবে, নেতা নয়; কেবল ব্যবহারকারী গড়ে তুলবে, সৃষ্টিশীল মানুষ নয়। অতএব সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাঠশালা কি থাকবে রাজপথে না পর্দায় বন্দি? নাকি আমরা শিক্ষক ও ছাত্র উভয়কেই তাদের প্রকৃত আসনে ফিরিয়ে আনব? উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয় তবে এখনই শুরু করতে হবে। কারণ শিক্ষকের কলম যখন থেমে যায় আর ছাত্রের স্ক্রিন যখন থামে না তখনই সভ্যতা বিপন্ন হতে পারে!
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক
কেকে/ এমএস