দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ ইস্যুতে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে রাজনীতিতে। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের দিন ঠিক করা হতে পারে। ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য রাজনীতিতে আলোচনা তৈরি করেছে।
বিএনপি উপদেষ্টা পরিষদ থেকে দলীয় লোকদের অপসারণ চেয়েছে। এর মধ্যে গত বুধবার জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম পাল্টা দাবি করেছেন, উপদেষ্টা পরিষদে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি আছে। সেক্ষেত্রে তাদেরও পদত্যাগ করতে হবে। অন্যদিকে একই দিন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কয়েকজন উপদেষ্টার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে এসেছে জামায়াতের ইসলামীও।
গত মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। ওই বৈঠকে বিএনপি দলীয় উপদেষ্টাদের অপসারণ চেয়েছে। দলীয় বলতে তারা দুই ছাত্র উপদেষ্টাকে বুঝিয়েছেন। এদিকে পরদিন, অর্থাৎ গত বুধবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে এনসিপি। বৈঠক শেষে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, দুই ছাত্র উপদেষ্টাকে যদি দলীয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে বিএনপি-জামায়াতের সুপারিশে যাদের উপদেষ্টা করা হয়েছে, তাদেরও দলীয় উপদেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে বিতর্কমুক্ত থাকা উচিত। সে কারণে উপদেষ্টা পরিষদে যে বিতর্কিত দুই উপদেষ্টা আছেন, নির্বাচনের আগে তাদের সরে যেতে হবে। বিশেষ করে দুই ছাত্র উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। কারণ সরকারের মধ্যে তারাই সবচেয়ে বিতর্কিত। এ ছাড়া আসিফ মাহমুদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তার বাবা ও আত্মীয়স্বজনরা স্থানীয়ভাবে প্রভাব বিস্তার করছেন। এনসিপির রাজনীতির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে মাহফুজ আলমের ভাইয়ের বিরুদ্ধেও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে। তাই নিরপেক্ষতার স্বার্থে এ দুই উপদেষ্টার সরকার থেকে সরে যাওয়া উচিত।
বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, এমন ধারণা করতে অসুবিধা হয় না যে এই দুই ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টা এনসিপির ঘনিষ্ঠ। তারা দলটির পরামর্শকের ভূমিকায় থাকেন। সর্বশেষ জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর করা নিয়ে সংকটের মধ্যে ১৪ অক্টোবর রাতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এনসিপির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করে। বৈঠকে দলটির পক্ষে অন্য নেতাদের পাশাপাশি অংশ নেন একজন ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টাও।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে যেসব বক্তব্য আসছে, তা সরকার ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর। এসব বক্তব্য জনগণের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করতে পারে। তাই এসব বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে।’ তিনি বলেন, দুই ছাত্র উপদেষ্টার উচিত পদত্যাগ করা অথবা ঘোষণা দেওয়া যে তারা নির্বাচন করবেন না এবং এনসিপির সঙ্গে তাদের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য কোনো সম্পর্ক নেই।
বিতর্কিত উপদেষ্টাদের সরে যেতে হবে
নিরপেক্ষতার স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারকে অতিসত্বর ‘কেয়ারটেকার’ আদলে যেতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে-বাইরে যাদের নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করার সুযোগ আছে, তাদের রেখে নিরপেক্ষতা রক্ষা করা যাবে না। সেজন্য আমরা বলেছি, অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা যেসব উপদেষ্টাকে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, নির্বাচনের আগে তাদের সরকার থেকে চলে যেতে।’
কয়েকজন উপদেষ্টাদের বিষয়ে আপত্তি
গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে কয়েকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তবে কাদের নিয়ে এই আপত্তি, তাদের নাম প্রকাশ করেনি দলটি। জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনার (প্রধান উপদেষ্টা) প্রতি আমাদের আস্থা আছে। কিন্তু আপনার কিছু লোক আপনার পাশে আপনাকে বিভ্রান্ত করে এবং ওরা কোনো একটা দলের পক্ষে কাজ করে আমরা মনে করি। তাদের ব্যাপারে আপনাকে হুঁশিয়ার থাকা দরকার।’
বিভিন্ন দল প্রশাসনে ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে
গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে এনসিপিও। বৈঠক শেষে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘বড় রাজনৈতিক দলগুলো জেলা প্রশাসক-পুলিশ সুপারের মতো পদ ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হবে। সরকার যাতে নিরপেক্ষভাবে চলে এবং উপদেষ্টা পরিষদের যাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, তাদের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছি।’
অন্তত একজন সরকারে থাকতে চান
অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে দুই ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টাকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পদত্যাগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা আরো সময় নিতে চেয়েছেন। সরকারের দায়িত্বশীল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে, ছাত্র প্রতিনিধিদের কেউ না কেউ উপদেষ্টা পরিষদে শেষ পর্যন্ত থাকুক, এটা চান ছাত্র উপদেষ্টারা। তারা মনে করছেন, না থাকলে উপদেষ্টা পরিষদে কেউ কেউ তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারেন।
আরও জানা গেছে, মাহফুজ আলম আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে এখন পর্যন্ত আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তিনি সরকারে থাকতে চান। আসিফ মাহমুদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে পদত্যাগ করতে পারেন। অবশ্য কোনো বিষয়েই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
কেকে/ এমএস