ঢাকা দুনিয়ার অনিরাপদ শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)’-এর ‘সেইফ সিটি ইনডেক্স (এসসিআই)’-এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ শহরের তালিকায় নিচের দিক থেকে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে ঢাকা। সব দিক বিবেচনায় ঢাকা বসবাসের অনুপোযোগী শহরে পরিণত হয়েছে।
দ্রুত নগরায়ন, অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনা, জনবহুলতা এবং মৌলিক পরিষেবা ও অবকাঠামোগত দুর্বলতার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা। ঢাকা শহর আজ মেগা প্রজেক্টের নগর- মেট্রোরেল, বিআরটি, এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার- সবই উন্নয়নের বিরাট বিরাট প্রতীক। কিন্তু এই অগ্রগতির উন্নয়নের ডামাডোলের নীচে যে অনিরাপত্তা লুকিয়ে আছে তা যেন কারো চোখেই পড়ছে না। প্রতিটি প্রকল্প উদ্বোধনের পরই রাষ্ট্র ও কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব যেন শেষ হয়ে যায়। চলছে অবহেলা, শৈথিল্য, দায় এড়ানো আর সমন্বয়হীনতার প্রতিযোগিতা। অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কাঠামোগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয় সেটি ভুলেই গেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। প্রায়ই এই কাঠামোগত নিরাপত্তাহীনতার ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের বলি হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
গত ২৬ অক্টোবর রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেটে মেট্রোরেলের একটি পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে আবুল কালাম আজাদ নামে যে পথচারীর মৃত্যু হয়েছে। সেটি এই কাঠামোগত নিরাপত্তাহীনতারই কারণ। একই স্থানে কাছাকাছি আরেকটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনা ঘটেছিল ১৩ মাস আগেও। ফলে মেট্রোরেল ব্যবস্থার নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। ব্যস্ততম নগরী ঢাকার মানুষকে যানযটের হাত থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছে এই মেট্রোরেল। কিন্তু সেই মেট্রোরেলের অব্যবস্থাপনার বলি হতে হলো আবুল কালাম আজাদকে।
একই ধরনের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার দুটি ঘটনা অল্প সময়ে ঘটায় বোঝা যায় নির্মাণের মানে সমস্যা ছিল। এর আগে ২০১২ সালে চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার ভেঙে ৯ জনের মৃত্যু, ২০২২ সালে গাজীপুরের বিআরটি প্রকল্পে গার্ডার পড়ে একই পরিবারের পাঁচজনের মৃত্যু। ২০২৩ সালে তেজগাঁও এলাকায় ক্রেন ভেঙে পড়ে এক নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সামগ্রিক অব্যবস্থাপনাকেই নির্দেশ করে। এ বছরের শুরুতে পান্থপথ ফ্লাইওভারে বড় ফাটল এবং নতুন উদ্বোধন করা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কিছু অংশেও ইতোমধ্যে দুর্ঘটনা ও ত্রুটি, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সীমাহীন অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার প্রকাশ ঘটায়। ফলে এই রাষ্ট্রে মেগা প্রকল্পের বিয়ারিং প্যাড খুলে আবুলকালামের নিহত হওয়ার ঘটনাকে কোনোভাবেই আর দুর্ঘটনা বলা যায় না। এটি রাষ্ট্রের সিস্টেমেটিক খুন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন মেট্রোরেল ‘নির্মাণের প্রযুক্তি শত বছরের পুরোনো। তাই সমস্যা নকশায় নয়, নির্মাণে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের কারণেও এত দ্রুত প্যাড খুলে পড়া সম্ভব নয়।’ নির্মাণ তদারকিতে থাকা জাপানি পরামর্শকরা হয়তো যথাযথভাবে কাজ করেননি। এখন যেটি দরকার তা হলো ২১ কিলোমিটার লাইনের সব ঝুঁকিপূর্ণ অংশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অডিট করা, সমস্ত মেগা উন্নয়ন প্রকল্পগুলো কাঠামোগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং একটি জাতীয় অবকাঠামো নিরাপত্তা কমিশন গঠন, যা স্বাধীনভাবে সব মেগা প্রকল্পের নিরাপত্তা পর্যালোচনা করবে। একই সঙ্গে প্রতিটি দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে, যাতে দায় নির্ধারণ ও সংস্কারের বাস্তব পদক্ষেপগুলো নিতে সুবিধা হয়। পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের মতো সেন্সরভিত্তিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে উড়ালপথ, পিলার ও রেললাইনগুলোর অবস্থা রিয়েল টাইমে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়। না হলে মানুষের মধ্যে যে ভয় তৈরি হয়েছে, তা আরো বাড়বে, মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়নের মূলে রয়েছে মানুষের সামগ্রিক উন্নয়ন।
কেকে/এজে