রাজধানীর কাকরাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা গুরুতর আহত হয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। গতকাল শুক্রবার রাতে হামলার শিকার হন তিনি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, নুরুল হকের মাথায় আঘাত রয়েছে। তার নাকের হাড় ভেঙে গেছে। জ্ঞান ফিরলেও শঙ্কামুক্ত নন তিনি।
এর আগে, সন্ধ্যায় জাতীয় পার্টি (জাপা) ও গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দেশেজুড়ে জাপাকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জানিয়েছে, জাপাকে নিষিদ্ধের আইনগত দিক যাচাই-বাছাই করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ ছাড়া নুরের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এদিকে নুরের ওপর নৃশংস হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ হামলায় জড়িত কেউ রেহাই পাবে না বলেও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। গতকাল বিকেলে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দেয় সরকার। বিবৃতিতে বলা হয়, প্রভাব বা পদমর্যাদা যাই হোক না কেন, এ ঘটনায় জড়িত কেউ জবাবদিহিতা থেকে রেহাই পাবে না। স্বচ্ছতা ও দ্রুততার সঙ্গে বিচার নিশ্চিত করা হবে। এ ছাড়া নুরের ওপর হামলার ঘটনায় রাজধানীসহ সারা দেশে বিক্ষোভ করেছে গণঅধিকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
এ সময় বিক্ষোভকারীরা ‘জাপা ধর, জেলে ভর’ স্লোগান দিতে থাকেন। তারা বলেন, রাজধানীর বিজয়নগরে হামলার ঘটনায় জড়িত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। আওয়ামী লীগের সহযোগী জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করতে হবে৷ স্বৈরাচারের সহযোগী দলটির নেতাকর্মীদেরও গ্রেফতার করতে হবে।
রাজধানীর কাকরাইলে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতীয় পার্টি (জাপা) ও গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। জাপার কার্যালয়ের সামনে দিয়ে গণঅধিকার পরিষদের একটি মিছিল যাওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাঠিপেটায় গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হকসহ বেশ কয়েকজন আহত হন।
গণঅধিকার পরিষদ বলেছে, মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় জাপার নেতাকর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালান। তবে জাপা বলেছে, মিছিল নিয়ে এসে জাপার নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালান গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীরা।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান গত শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বলেন, জাপার হামলার প্রতিবাদে রাত সাড়ে ৯টার দিকে গণঅধিকার পরিষদের কার্যালয়ের সামনে সভাপতি নুরুল হক, তিনিসহ নেতাকর্মীরা সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঠিক এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের ওপর হামলা চালান। এ সময় সভাপতি নুরুল হক, তিনিসহ শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন।
এ ঘটনায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ঘটনার শুরুতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উভয় পক্ষকে শান্ত থাকতে অনুরোধ জানান। তবে বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও কিছু নেতাকর্মী তা উপেক্ষা করে মব ভায়োলেন্সের মাধ্যমে পরিস্থিতি অশান্ত করার চেষ্টা করেন। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালান এবং আনুমানিক রাত ৯টার দিকে মশাল মিছিলের মাধ্যমে সহিংসতা আরও বাড়ান। তারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন দেওয়ার চেষ্টা চালান। জননিরাপত্তা রক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়। এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর পাঁচজন সদস্য আহত হন বলে জানিয়েছে আইএসপিআর।
এদিকে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হকের (নুর) ওপর হামলা-মারধরের ঘটনাকে গভীর ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের অংশ বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, জাপা ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মানুষের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করেছে। তারা জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করে নিজেদের পুরোনো ইতিহাস উন্মোচন করেছে। তাই দলটিকে নিষিদ্ধের যে দাবি উঠেছে, সেটির আইনগত দিক যাচাই-বাছাই করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নিন্দা
নুরের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাঠিপেটার ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। রাজনৈতিক দলগুলো নুরুল হকের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চাকে ব্যাহত করে, এমন কোনো কর্মকাণ্ডকে বিএনপি সমর্থন করে না। সুস্থ ধারার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হামলাকে আমরা নিন্দা জানাই।’
এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ এবং তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য মিয়া গোলাম পরওয়ার। বিবৃতিতে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের পতনের পরও এমন হামলার ঘটনা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক, অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত। আমরা একটি গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ ও সহনশীল রাজনৈতিক পরিবেশ প্রত্যাশা করি। অবিলম্বে হামলাকারীদের গ্রেফতার করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মিয়া গোলাম পরওয়ার।
ছাত্রদল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের সম্মুখসারির নেতারা ও অভ্যুত্থানের পক্ষশক্তির ওপর এ ধরনের নৃশংস হামলা অভাবিত। গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ ধরনের অনিয়ন্ত্রিত আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল যৌথ বিবৃতিতে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক, সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানসহ নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি রিফাত রশীদ এক বিবৃতিতে বলেন, নুরুল হকের ওপর হামলার ঘটনা অন্তর্বর্তী সরকারের নানা ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ। এ হামলা জুলাই শহিদদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। বিভিন্ন মহল নানা মোড়কে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের ‘ষড়যন্ত্রে লিপ্ত’ উল্লেখ করে বিবৃতিতে রিফাত রশীদ বলেন, এর অন্যতম অংশ জাতীয় পার্টি। ইসলামী আন্দোলন বলেছে, ফ্যাসিবাদবিরোধী একজন নেতাকে রাস্তায় লাঠিপেটা করার ঘটনা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান।
বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি হবে: প্রেস সচিব
নুরের ওপর হামলার ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাঠিচার্জে নুরুল হক নুর, রাশেদ খান ও ছাত্র অধিকার পরিষদের নাজমুল হাসান আহত হয়েছেন। এই লাঠিচার্জের জন্য একটি জুডিশিয়াল তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।উচ্চ আদালতের একজন বিচারকের নেতৃত্বে এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলেও জানান তিনি।
জাপাকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিষিদ্ধের দাবি
জাতীয় পার্টিকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিষিদ্ধ করাসহ তিনটি দাবি জানিয়েছে গণঅধিকার পরিষদ। অন্য দাবি দুটি হলো, নুরের ওপর হামলার ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা এবং হামলার ঘটনার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে হবে।
গতকাল বিকেলে রাজধানীর বিজয়নগরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক প্রতিবাদ সমাবেশে দাবিগুলো তুলে ধরেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান।
সমাবেশে বক্তারা জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। এর আগপর্যন্ত রাজপথে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা বলেন। সমাবেশে নুরুলের ওপর হামলার ঘটনা পরিকল্পিত বলে দাবি করা হয়।
সমাবেশে ‘লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে, ‘নুরের ওপর হামলা কেন, প্রশাসন জবাব দে’, ‘আওয়ামী লীগের ঠিকানা, এই বাংলায় হবে না’, ‘জাতীয় পার্টির ঠিকানা, এই বাংলায় হবে না’, ‘ওয়ান টু থ্রি ফোর, জাতীয় পার্টি নো মোর’, ‘জাতীয় পার্টির আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেওয়া হয়।
এ সময় রাস্তায় টায়ার পোড়ানো হয়। পরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি পুরানা পল্টন মোড়, জাতীয় প্রেসক্লাব, মৎস্য ভবন, কাকরাইল মোড়, বিজয়নগর মোড় হয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে শেষ হয়।
এ ছাড়া জাতীয় পার্টিকে ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদের চিহ্নিত এজেন্ট’ বলে মন্তব্য করেছে হেফাজতে ইসলাম। তারা বিচারিক প্রক্রিয়ায় দলটিকে নিষিদ্ধ করতে সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে। শনিবার হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা সাজেদুর রহমান ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনাইদ আল হাবিব এক বিবৃতিতে এই দাবি করেছেন।
কেকে/ এমএস