গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ। ক্ষমতা হারানোর এক বছর পরও রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয় হতে পারেনি দলটি। বর্তমানে দলটির কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নানাভাবে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ।
নিজেদের ফিরে আসার কৌশল খুঁজছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতাকে কাজে লাগিয়ে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলটি। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন মতবিরোধকে পুঁজি করে তাদের মধ্যে বিভাজন-বিভেদ সৃষ্টি করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পাঁয়তারা করছে দলটির নেতাকর্র্মীরা। এ ছাড়া দলটিকে ষড়যন্ত্রের ইন্ধন দিচ্ছে প্রতিবেশী দেখের গোয়েন্দ সংস্থা।
তারই অংশ হিসেবে বিদেশে বসে নানা পরিকল্পনা করছেন আওয়ামী লীগের পলাতক সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় অনেক নেতা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে প্রকাশ্যে চলে এসেছেন নেতারা। চলতি বছরের পাঁচ আগস্টের পর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের জন্য ভারতে জড়ো হতে দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের এসব নেতাদের। আবার যুক্তরাজ্যে ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশেও সক্রিয় হচ্ছেন তারা। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও শীর্ষ নেতা নানা অনুষ্ঠান ও দলীয় কর্মসূচিতে অংশও নিয়েছেন।
বিভিন্ন কর্মসূচিকে সামনে রেখে সেখানে সভা-সমাবেশও করছেন তারা। একইসঙ্গে তারা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা এবং দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য নানা ষড়যন্ত্রও করছেন বলে আভাস পাওয়া গেছে। এদিকে দেশের ভেতরে ঝটিকা দিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে শুরু করেছে পতিত আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন এজেন্সির সঙ্গে যোগসাজশ করে ষরযন্ত্রের নকশা আঁকছেন দলটির প্রভাবশালী নেতারা।
অতিসম্প্রতি নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেট অফিসে ঢোকার সময় আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে হেনস্তার চেষ্টা করেছেন। নিউইয়র্কে স্থানীয় সময় গত রোববার সন্ধ্যায় এ ঘটনা ঘটে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ কনস্যুলেট অফিস রোববার এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য উপদেষ্টা।
মাহফুজ আলম ঢোকার সময় কনস্যুলেট অফিসের সামনে আওয়ামী লীগের পতাকা হাতে, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে কর্মী ও সমর্থক বিক্ষোভ করেন। তারা মাহফুজ আলমকে উদ্দেশ করে ডিম ছোড়েন। তারা মাহফুজ আলমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেন। কনস্যুলেট ভবনের কাচের দরজা ভেঙে ফেলেন।
কয়েক মাস আগে যুক্তরাজ্যে সফররত প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হোটেলের সামনেও বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। হেনস্তা করার চেষ্টা করা হয় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস-সচিব শফিকুল আলমকে।
এদিকে রাজধানীর রাজপথে আবারও প্রকাশ্যে মিছিল করেছে কার্যক্রম নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগ। গত রোববার দুপুরে গুলিস্তানে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় এ ঝটিকা প্রতিবাদী মিছিল।
দলটির নিবন্ধন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। দলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা ভারতে পালিয়ে গেছেন। তবুও বারবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল করে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় এলেও আওয়ামী লীগ হয়তো আগেভাগেই অদৃশ্য রাজনৈতিক দরকষাকষির ক্ষেত্র তৈরি করতে চাইছে। এর আগে ঢাকার বিমানবন্দর এলাকাতেও ঝটিকা মিছিল করেছে দলটির নেতাকর্মীরা। রাজধানীর বাইরে ছাত্রলীগও একই ধরনের কর্মসূচি করেছে। জুলাই আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শত শত মানুষ হত্যার অভিযোগ ঘাড়ে নিলেও নিষিদ্ধ দলটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ্যে আসছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শামীম ওসমানের এক ঘনিষ্ঠজনের নেতৃত্বে গুলিস্তানে ঝটিকা মিছিল করে নেতাকর্মীরা। রাজধানীতে দলের সক্রিয় কার্যক্রম দেখাতে প্রকাশ্যে আসছে তারা। রাজনৈতিক বিভাজনের সুযোগে শক্তি বাড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ।
তবে জুলাই আন্দোলন দমনে সহিংসতার বিষয়ে দলটির কোনো অনুশোচনা দেখা যাচ্ছে না, যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সমালোচনা চলছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সাড়ে ১৫ বছরের দীর্ঘ শাসনামলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার অহংকারে রাজনীতি বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো এবং এমনকি সাধারণ মানুষকেও ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। দলটি একা হয়ে পড়েছিল।
সেই পটভূমিতে পতনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের দমননীতির কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এছাড়া বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ যে দলগুলো বর্তমানে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারও আওয়ামী লীগ বিরোধী অবস্থানে রয়েছে।
আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানাচ্ছে, দলটিতে এখনো শেখ হাসিনার একক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তার নেতৃত্বেই দলকে সংগঠিত করার চেষ্টা চলছে।
তবে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় দলের রাজনীতিতে আগের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয় হয়েছেন। দলটির নেতাদের অনেকের ধারণা, তাদের নেত্রীর নেতৃত্বে সজীব ওয়াজেদ জয়কে সামনে রেখে দলটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এখন ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ সরকার আওয়ামী লীগ ও এর মিত্র দলগুলোর এ নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সুযোগ রাখছে না এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হবে না, এই বক্তব্য নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত দলটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ও দেশের ভেতরে জনমত তৈরির চেষ্টা করবে বলেও এর নেতারা বলছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে গণঅভ্যুত্থানের কৃতিত্বের দাবি নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ সক্রিয় দলগুলো এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন সংগঠন বিতর্কে জড়িয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। তাদের পাল্টাপাল্টি দাবিতে এক ধরনের বিভক্তিও তৈরি করছে। এই পরিস্থিতিটাকে আওয়ামী লীগ তাদের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের পক্ষে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরছে।
দলটি জুলাই-আগস্টের আন্দোলন দমনের চেষ্টার ক্ষেত্রেও জামায়াত-শিবিরসহ বিভিন্ন পক্ষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছিল। আওয়ামী লীগের শাসনের পতনের পরও তারা ঘটনাপ্রবাহকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হিসেবেই সামনে আনে। এখন সেই আন্দোলনের কৃতিত্বের দাবি নিয়ে এর অংশীজনদের বিভক্তির প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ মনে করছে, তাদের প্রতি মানুষের নেতিবাচক ধারণার পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
দেশের ভেতরে রাজনীতির সুযোগ না পাওয়া পর্যন্ত জুলাই অভ্যুত্থানে ভূমিকার জন্য আওয়ামী লীগও কোনো অনুশোচনা প্রকাশ করবে না বলে দলটির একাধিক নেতা বলেছেন। তারা মনে করেন, এখন অনুশোচনা প্রকাশ করা হলে তাদের নেতাকর্মীদের মনোবলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যদিও এর নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, তাদের শাসনের পতনের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দমননীতি চালানো ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে দেশ-বিদেশে পালিয়ে থাকা দলের নেতাদের মধ্যে পর্যালোচনা হয়েছে।
সেই আন্দোলন সামলাতে সে সময় রাজনৈতিক দিক থেকেও দলটির সরকার একের পর এক ভুল পদক্ষেপ নিয়েছে, এমন আলোচনাও তাদের ভেতরে হয়েছে। কিন্তু সেই ভুল প্রকাশ্যে স্বীকার করার চিন্তা এখনো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদের মতে, এবার আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানের জন্য নির্ধারক হবে দুইটি বিষয় এক, নেতৃত্ব দিয়ে দলটি কী করতে পারে, এবং দুই, জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সরকার ব্যর্থ হলে সুযোগ তৈরি হতে পারে। তিনি বলেন, যে সরকার আছে বা যে সরকার আসবে তারা যদি জনআকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়, সে সুযোগটা আবার আওয়ামী লীগ নিয়ে নেবে। নিষিদ্ধ করলেই যে কামব্যাক করতে পারবে না, এমন কোনো কথা নাই। জামায়াত তার জীবনে চারবার নিষিদ্ধ হয়েছে, জামায়াত তো আছে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে আসা সময়সাপেক্ষ হবে।
কেকে/ এমএস