বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে বৈঠক করেছেন ঢাকা সফররত পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। এর মধ্যে বিএনপির কেউ বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি। প্রথম বৈঠকে এনসিপি সরাসারি বলেছে, দুদেশে সম্পর্কের অন্তরায় একাত্তোর ইস্যু, এটার সমাধান করা উচিত। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে জামায়াত বলেছে, এটা সরকার করবে।
তিন দলের সঙ্গে বৈঠক ইসহাক দারের
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে বৈঠক করেছেন ঢাকায় সফররত পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। গতকাল শনিবার বিকালে রাজধানীর গুলশানে পাকিস্তান হাই কমিশনে প্রথমে এনসিপির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। এরপর জামায়াতে ইসলামী এবং সন্ধ্যায় বিএনপির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন ইসহাক দার।
বিএনপির ৬ সদস্যের প্রতিনিধি দলে নেতৃত্ব দেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপির প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা হলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ।
‘দুদেশের অমীমাংসিত ইস্যু ঠিক করবে সরকার’
জামায়াতে ইসলামীর ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন ইসহাক দার। বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব দেন দলের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের।
পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো রয়েছে, তা দুই দেশের সরকারের বিষয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। ঢাকা সফররত পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি এ কথা বলেন। বৈঠকে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গও এসেছে।
বৈঠক শেষে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়, আঞ্চলিক বাণিজ্য এবং কীভাবে সম্পর্ক আরো বৃদ্ধি করা যায়, এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামী দিনে ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরো কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় এবং আঞ্চলিক জোট সার্ককে কীভাবে আরো সক্রিয় ও শক্তিশালী করা যায়, এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
প্রায় ১৫ বছরের বৈরী সম্পর্ক কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া নিয়ে কী কথা হয়েছে জানতে চাইলে জামায়াতের এই নেতা বলেন, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কিছুটা একপেশে ছিল। তিনি বলেন, ‘এখন বাংলাদেশ সরকার বা আমরা সবাই মনে করি যে, এই অঞ্চলে সব প্রতিবেশী দেশের সঙ্গেই আমাদের সুসম্পর্ক থাকা দরকার। সেটার ব্যাপারে দুই পক্ষই জোর দিয়েছি।’
সরকারের সঙ্গে আগামীকাল দ্বিপক্ষীয় বৈঠক রয়েছে উল্লেখ করে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যেসব অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে, সেগুলো অনুকূল পরিবেশে দ্রুত শেষ করা দরকার।
’৭১-এর অমীমাংসিত ইস্যুগুলো বৈঠকে আপনারা তুলেছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘এসব বিষয় হচ্ছে দুই দেশের সরকারের আলোচনার বিষয়। আমরা আশা করি, সরকার সেগুলো আলোচনা করবে।’ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচন কখন কীভাবে হবে সেটা প্রাসঙ্গিকভাবে আসছে। এটা নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি।
ইসহাক দারের সঙ্গে বৈঠক
৭১-ইস্যুকে ‘ডিল’ করা উচিত বলে মনে করে এনসিপি
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের অতীতের বৈরী সম্পর্ক থেকে বের হয়ে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন। পাশাপাশি দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে একাত্তরের ইস্যু পাকিস্তানের ‘ডিল’ করা উচিত বলে মনে করেন দলটি।
শনিবার বিকেলে পাকিস্তান হাইকমিশনে ঢাকা সফররত পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে এনসিপির সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। সেখানেই এসব কথা বলা হয় বলে জানান এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন।
বৈঠক শেষে এনসিপি সদস্যসচিব আখতার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তান নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের যে ধারণা, সেটা তাদের কাছে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। এনসিপি মনে করে বিগত সময়ে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যকার যে শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্ক ছিল, সেখান থেকে উন্নতির সুযোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে জনগণের যে পারসেপশন, সেটাকে আমাদের সবচেয়ে সেনসিটিভ আকারে বিবেচনায় রাখতে হবে। আমরা মনে করি বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে, যে কোনো ধরনের সম্পর্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ’৭১ ইস্যুকে অবশ্যই ডিল করা উচিত। আমরা সে প্রসঙ্গ তাদের কাছে উত্থাপন করেছি।
’৭১-এর-অমীমাংসিত তিন ইস্যু সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায়। এ নিয়ে ইসহাক দার কিছু বলেছেন কি না, জানতে চাইলে আখতার হোসেন বলেন, বিষয়টি পাকিস্তান জানাবে। একই বিষয়ে সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আমরা তাদের বলেছি, ৭১ বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা উচিত। তারা বলেছে, তারা এটাতে প্রস্তুত।’
পাকিস্তানের গণমাধ্যমে সম্পর্ক উন্নয়নের বার্তা
দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। তার এ সফরকে আঞ্চলিক কূটনীতিতে ঐতিহাসিক ব্রেকথ্রু হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।
সংবাদমাধ্যম পাক ট্রিবিউন জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনসহ বাংলাদেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন ইসহাক দার। এসব বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিকসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হবে।
সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কূটনীতিকরা এটিকে দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাস পুনঃস্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে দেখছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তা নিয়ে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো ছিল না।
পাক ট্রিবিউন বলেছে, সাবেক স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিদায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে সংলাপ এবং সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বৃদ্ধির নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
ইসহাক দারের এ সফরে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে বলে উভয় দেশের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন। বাণিজ্য বৃদ্ধি, ভিসা প্রক্রিয়া সহজ, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং সম্মিলিতভাবে আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রতিষ্ঠায় এসব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে বলে জানিয়েছে পাক ট্রিবিউন।
সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, আঞ্চলিক পর্যবেক্ষকরা দেখছেন, পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য করিডর বৃদ্ধি করতে চায়। তারা বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির সুযোগ নিতে চায়।
অপরদিকে বাংলাদেশ পাকিস্তানি বাজারে আরো প্রবেশাধিকার, টেক্সটাইল ও তথ্যপ্রযুক্তির মতো খাতে দক্ষতা অর্জন এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে আরো বৃহৎ সহযোগিতা চায়।
ইসহাক দারের এ সফরকে পাকিস্তানের একটি কৌশল হিসেবেও দেখা হচ্ছে, যার লক্ষ্য হলো আঞ্চলিক সম্পর্কগুলো নতুন করে সাজানো। এক্ষেত্রে এমন অংশীদারত্ব গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যা ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যেও টিকে থাকতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, ইসলামাবাদ ও ঢাকার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বাড়াতে পারে, বিশেষত যখন প্রতিবেশী অঞ্চলগুলোতে উত্তেজনা বাড়ছে।
সফরের দ্বিতীয় দিন রোববার সকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে একান্তে এবং প্রতিনিধি পর্যায়ে বৈঠক করবেন ইসহাক দার। প্রায় দুই ঘণ্টার বৈঠক শেষে দুই দেশের মধ্যে ছয়টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সইয়ের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে।
সইয়ের জন্য চূড়ান্ত হওয়া চুক্তির তালিকায় রয়েছে দুই দেশের সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের ভিসা বিলোপ চুক্তি। চূড়ান্ত হওয়া এমওইউগুলো হচ্ছে, দুই দেশের বাণিজ্যবিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন, সংস্কৃতি বিনিময়, দুই দেশে ফরেন সার্ভিস একাডেমির মধ্যে সহযোগিতা, দুই রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার মধ্যে সহযোগিতা এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সঙ্গে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইপিআরআই) মধ্যে সহযোগিতা।
কেকে/ এমএস