রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নে আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য বহনকারী এক মন্দিরের নাম ঝাউগ্রাম শিববাড়ী মন্দির। শুধু ইট-পাথরের গাঁথুনি নয়, এ মন্দির যেন ভক্তির মূর্ত প্রতীক, এক জীবন্ত ইতিহাস।
প্রায় সাড়ে সাতশো বছর আগে যে পবিত্র শিলার উপর দুধ ঢেলেছিল একটি গাভী, আজও সেই ঐতিহাসিক স্থানটিকে ঘিরে জমে ওঠে অগণিত মানুষের বিশ্বাসের মেলা।
শ্রাবণ মাস এলেই বদলে যায় এ অঞ্চলটির চিত্র। সোমবার ভোর থেকেই শুরু হয় ভক্তদের আগমন। কারও হাতে ফুল, কারও মাথায় দুধের কলসি। কেউ এসেছেন বহু বছর ধরে, আবার কেউ এসেছেন প্রথমবার—শুধু মনভরে শিবলিঙ্গে দুধ ঢেলে নিজের মনের বাসনা জানানোর আশায়।
বেলপাতা, ধূপ, মোমবাতি, ঘি আর মধু—সব কিছুতেই যেন মিশে থাকে অদ্ভুত এক শ্রদ্ধা আর অভিমান। কেউ চোখ বুজে প্রার্থনা করেন, কেউ কাঁপা হাতে ছোঁয়ান শিবলিঙ্গের গা। মন্দিরের চারপাশে তখন শুধুই ‘বোল বোম... বোল বোম...’ ধ্বনি।
এ মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে এক রহস্যঘেরা কাহিনী। কথিত আছে, রাজা সীতারাম রায়ের আমলে এ জায়গাটি ছিল ঘন বন। এক রাখাল বালক লক্ষ্য করেন, একটি গাভী প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজে থেকেই দুধ ঢালছে একটি পাথরের উপর। পরে লোকজন এসে দেখেন, সেটি কোনো সাধারণ পাথর নয়—বরং একটি শিবলিঙ্গ। সেই থেকে শুরু পূজা, আর ক্রমেই গড়ে ওঠে এ জাগ্রত শিবমন্দির।
শিব মন্দিরের সেবায়েত সবিতা রানী পাল জানান, তাদের পরিবার তিন প্রজন্ম ধরে এ মন্দিরের পূজার দায়িত্ব পালন করে আসছেন। শুধু ফুলপাতা জোগাড় করাই নয়, দূর-দূরান্ত থেকে আসা ভক্তদের পূজার নিয়ম শেখানো, নিয়ম না মানলে বিপদের আশঙ্কা—সবই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এতসব ইতিহাস, এত ভক্তির মাঝেও ভাগ্য বদলায়নি মন্দিরের।
মন্দিরটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি বিদ্যুৎ কর্মকার বলেন, ‘এটা শুধু একটা মন্দির নয়, আমাদের আত্মার অংশ। অথচ চারদিকে নেই কোনো বাউন্ডারি প্রাচীর, নেই বিশ্রামাগার, রান্নাঘর কিংবা অফিস কক্ষ। বর্ষায় তো কাদা মাড়িয়ে মন্দিরে পৌঁছানোই দায় হয়ে যায়।’
তিনি আরো জানান, মন্দিরের নিজস্ব ৩৩ শতাংশ জমি থাকলেও সরকারি বা স্থানীয় সহায়তার অভাবে মন্দির এখন উপেক্ষিত। কমিটির নিজস্ব উদ্যোগে টয়লেট, টিউবওয়েল স্থাপন করা হলেও, এই তীর্থস্থানকে সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন বৃহৎ উদ্যোগ। রাজবাড়ীর ঝাউগ্রামের এ শিববাড়ী মন্দির শুধু ধর্মীয় কেন্দ্র নয়, বরং হিন্দু সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের একটি জীবন্ত দলিল। আজ যদি আমরা এ মন্দিরের দিকে ফিরে না তাকাই, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো আর জানতেই পারবে না —কোথা থেকে শুরু হয়েছিল এ বিশ্বাস, এই ভক্তি, এই ইতিহাস।
কেকে/ এমএস