চট্টগ্রাম জেলা ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই জেলার প্রতিটি স্থানেই রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নিদর্শন। এর মধ্যে হাটহাজারীর ফকিরা মসজিদ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এটি সুলতানী আমলে নির্মিত একটি ঐতিহাসিক মসজিদ, যা চট্টগ্রামের প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে।
ফকিরা মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল ১৪৭৪-১৪৮১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, যা সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহের শাসনামলে সম্ভবত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক মৌলভী হামিদ উল্লা খান বাহাদুর তার রচিত ‘আহাদীস-উল-খাওয়ানীন’ গ্রন্থে মসজিদটির উল্লেখ করেছেন। ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. আবদুল করিম মসজিদের শিলালিপি পাঠ করে তার বর্ণনা দিয়েছেন এবং মসজিদটিকে চট্টগ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
মসজিদটির স্থাপত্য শৈলী ইসলামী ঐতিহ্যের আদলে নির্মিত হয়েছে। মসজিদের চারকোণে রয়েছে চারটি সংলগ্ন বুরুজ (টাওয়ার) যা ঐ সময়ের নির্মাণ শৈলীর নিদর্শন। মসজিদটির মিহরাব, যা মূলত এক আধা উঁচু বুরুজের মতো তৈরি, অত্যন্ত সুন্দর এবং ঐতিহ্যবাহী। মসজিদের সকল বুরুজ বা মিনার অষ্টকোণাকৃতি, যা শীর্ষদেশে ছোট একটি গম্বুজ দ্বারা আবৃত। এই গম্বুজ ও বুরুজগুলো একে অপরের সাথে সঙ্গতি রেখে মসজিদটির স্থাপত্যশৈলীর সঠিকতা বজায় রেখেছে।
মসজিদের পূর্ব দেওয়ালে তিনটি খিলান রয়েছে, যা খুব নিচু ও সূঁচালো। এই খিলানগুলির মাধ্যমে মসজিদটির ঐতিহাসিক সৌন্দর্য ও শৈল্পিক আবেদন প্রতিফলিত হয়। মসজিদটির বর্তমান অবস্থা এখনও ঐতিহ্যবাহী রূপে রক্ষা করা হয়েছে। তবে আধুনিক সময়ের উপকরণ যেমন টাইস ও মোজাইক পাথর দিয়ে মসজিদটি সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার চেষ্টা করা হয়েছে। যদিও এই আধুনিক সংস্করণ প্রকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণ পদ্ধতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তবে এটি মসজিদটির সৌন্দর্য ও দর্শনীয়তা বাড়িয়েছে।
মসজিদটির চারপাশে একটি বৃহৎ প্রাঙ্গণ রয়েছে যেখানে বহু মুসল্লি একত্রিত হতে পারেন। এটি স্থানীয় মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধর্মীয় স্থান, যেখানে তারা নিয়মিত জুমার নামাজ ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান আদায় করেন।
মসজিদটির পাশে একটি মাজারও রয়েছে, যা স্থানীয়দের মধ্যে আরেকটি ধর্মীয় গুরুত্ব বহন করে। এছাড়া, মসজিদের সামনে একটি তোরণও রয়েছে, যা মসজিদটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে এবং এই স্থানটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আরও বাড়িয়েছে।
ফকিরা মসজিদটির ইতিহাস ও স্থাপত্যশৈলী একে চট্টগ্রামের একটি গৌরবময় ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত করে। তবে দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের দেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ ধরনের ঐতিহাসিক স্থানগুলি সংরক্ষণে যথাযথ উদ্যোগ নেয়নি। এ ব্যাপারে কোনো নিশ্চিত পরিকল্পনা বা পদক্ষেপও নেই, যা মসজিদটির ভবিষ্যত সংরক্ষণের জন্য আশঙ্কাজনক হতে পারে। আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও ধর্মীয় স্থানগুলিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যত প্রজন্মও সেগুলির মূল্যায়ন ও উপকারিতা উপভোগ করতে পারে।
ফকিরা মসজিদ শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি আমাদের ইতিহাসের এক অমূল্য অংশ। এটি আমাদের প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন, যা কেবল চট্টগ্রাম নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয়। মসজিদটি আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যকে বহন করে এবং আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সেই মহান সময়কে, যখন এই মসজিদ নির্মাণ হয়েছিল।
এই প্রাচীন মসজিদটির সংরক্ষণ, সংস্কার ও এর ঐতিহ্য রক্ষার জন্য আমাদের আরও মনোযোগী হতে হবে, যাতে এটি ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে একটি অনুপ্রেরণা হয়ে থাকে।
কেকে/এমএ