গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠে আমন ধান রোপণের মৌসুম চলছে কালের আবর্তে হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার চিরচেনা গরুর হালচাষ। যান্ত্রিক যুগেও টিকে আছে গরুর হালচাষ-অতীতের ঐতিহ্যে ভর করে কিছু কৃষকের লড়াই, একটা সময় ছিলো যখন লাঙল-গরুর হাল ছাড়া জমি প্রস্তুতের কথা ভাবাই যেত না। কিন্তু কালের আবর্তে তা হারাতে বসেছে। তবে বাংলার এ অতীত ঐতিহ্যের চিত্র এখনো দেখা যায় বিভিন্ন গ্রামে।
কিশোরগঞ্জের পার্শ্ববর্তী নান্দাইল উপজেলার সিংরইল ইউনিয়নের আলাবক্সপুরে বিস্তীর্ণ মাঠে সকালে দেখা মিলল বিরল এক দৃশ্য হাটুসমান কাদায় নেমে দুই গরুকে সামনে রেখে চাষ করছেন কৃষক মো. আসাদ। ট্রাক্টর আর পাওয়ারটিলারের যুগেও তিনি আঁকড়ে ধরেছেন পূর্বপুরুষের চাষের ঐতিহ্য।
আসাদের চোখে হালের প্রতি এক অনন্য ভালোবাসা ‘ট্রাক্টর ভালো, কিন্তু হালের মতো মাটি নরম হয় না। গরুর হালে চাষ করলে আগাছা কম হয়, মাটির উর্বরতাও বেশি থাকে। হালচাষ শুধু কৃষি নয়, এটা আমাদের সংস্কৃতি। গরুর সঙ্গে কৃষকের সম্পর্কটা আত্মার মতো, যা যন্ত্র দিয়ে পাওয়া যায় না।’
তিনি একজন সফল গরুর খামারি তবে তার কণ্ঠে আক্ষেপও আছে ‘গরু পালন এখন ব্যয়সাপেক্ষ। খাবারের দাম বেশি, জমি কমে গেছে, তরুণরা কষ্টের কাজ করতে চায় না। তাই অনেকেই গরু বিক্রি করে দিয়েছে, হালচাষও বন্ধ হয়ে গেছে।’
গ্রামবাংলার ঐতিহ্য গরুর হাল। ছবি : খোলা কাগজ
আগেকার দিনে গ্রামবাংলায় ভোর হলেই শোনা যেত গরুর ঘণ্টার শব্দ। নারীরা শাড়ি পরে মাঠের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে হালচাষিদের জন্য খাবার নিয়ে যেতেন। কিন্তু যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় সেই দৃশ্য এখন কেবল স্মৃতিতে। তবুও সদর, করিমগঞ্জ, হোসেনপুর, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলী, বাজিতপুর, কটিয়াদি ও পাকুন্দিয়ার কিছু গ্রামে এখনও দেখা মেলে গরুর লাঙল-মইয়ের ব্যবহার। আধুনিক যান্ত্রিক কৃষিকাজ এসে বদলে দিয়েছে সেই দৃশ্য।
লতিফাবাদ ইউনিয়নের অষ্টবর্গ গ্রামের পেশাদার হালচাষি মনিরুল ইসলাম জানালেন, ‘আমাদের বিলে অনেক জমি আছে যেখানে ট্রাক্টর বা পাওয়ারটিলার দিয়ে চাষ সম্ভব হয় না। উঁচুনিচু জমিতে গরুর হালই সবচেয়ে কার্যকর। এটা জমির গভীরে যায়, মাটির উর্বরতা বাড়ায়। তাই আমাদের এলাকায় গরু দিয়ে হালের কদর এখনও আছে।’
কাটাবাড়ি গ্রামের ৭০ বছরের এক বৃদ্ধা স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘একসময় আমাদের গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই গরু ছিল। শাওন মাসে ক্ষেত লাগানোর মৌসুম এলে ফজরের পর গরুর ঘণ্টার শব্দে ঘুম ভাঙত গ্রামবাসীর। কিন্তু এখন টিলার আসার পর সবকিছু বদলে গেছে গরুর হালচাষ এখন খুবই কম দেখা যায়। যারা এখনও ব্যবহার করেন, তারা মূলত অভ্যাসের টানে এই প্রাচীন পদ্ধতিটা ধরে রেখেছেন।’
কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. সাদিকুর রহমান বলেন, ‘কিছু বিশেষ জমিতে এখনও গরুর হাল ব্যবহার অপরিহার্য। তবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের এই যুগে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষকদের অভ্যস্ত হওয়া জরুরি।’
যদিও সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে গরুর হালচাষ, তবুও কিছু কৃষকের হাত ধরে এই ঐতিহ্য টিকে আছে একটি গ্রামীণ ছবির মতো যা দেখলে মনে হয়, হয়তো সময় এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেছে।