বর্ষাকালে জোংরা পড়ে কাজ করছে একদল কিষানি। ছবি : খোলা কাগজ
বর্তমান উজিরপুর উপজেলা বরিশাল জেলার একটি উন্নত জনপদ। তবে ১৯৮০ সালের আগে এ জনপদের রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা তলানিতেই ছিল বলা চলে। প্রচুর বৃষ্টিপাত ও সন্ধ্যা নদীর জোয়ারের পানিতে নিচু রাস্তাঘাট তলিয়ে গিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা হতো। সে সময় এ এলাকার মানুষজনের অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন সচ্ছল ছিল না। কৃষিই ছিল এলাকাবাসীর প্রধান জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথ।
বর্ষার সিজনে বর্ষায় ছয়লাব আর গ্রীষ্মকাল বিশেষ করে চৈত্র মাসে থাকে কড়া রোধ। বর্ষা আর প্রখর রোদ থেকে নিজেকে সুরক্ষা করতে ছাতার (অ্যামব্রেলা) বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হতো তালপাতা আর বাঁশের চেড়া দিয়ে এক ধরনের আচ্ছাদন, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হতো জোংরা, জোমরা।
গ্রামভেদে জোংরা তালপাতা, গজারিপাতা বা সেগুনপাতা দিয়ে বানানো হতো জোংরা বা কৃষকের ছাতা। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে জোংরা বানানোর উপকরণে পরিবর্তন আসে। অনেক কৃষক, মজুর পলিথিন দিয়েও জোংরা বানিয়ে থাকতেন। দুই হাতে কাজ করতে হলে জোংরার বিকল্প আর কিছুই ছিল না। কারণ ছাতা মাথায় দিয়ে দুই হাত ব্যবহার করে কৃষি কাজ করা অসম্ভব।
গ্রাম বাংলার লোক-ঐতিহ্য ‘জোংরা’
জোংরা বর্ষাকালে খেতে কাজ করতে, হাটবাজারে যেতে বেশি ব্যবহার করত এলাকার লোকজন। প্রখর রোদেও তাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ও কৃষি কাজ করতে এর ব্যবহার পরিলক্ষিত হতো। এক কথায় বলতে কৃষকের ছাতা ছিল জোংরা। রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য জোংরা ছিল একমাত্র ভরসা। তখন ছাতার ব্যবহার খুবই কম ছিল। তখন ছাতা ছিল ধনী লোকদের হাতে। গ্রামের সাধারণ মানুষ ছাতা ব্যবহার করতেন কম। কেউ যদি কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন তখন পাশের বাড়ির কারো ছাতা থাকলে তার নিকট থেকে চেয়ে নিতেন।
উজিরপুর এলাকার হস্তিশুণ্ড গ্রামের দিনমজুর হান্নান হাওলাদার জানান, আমি ছোটবেলায় গাবপাতা বা বটপাতা এবং সারের প্লাস্টিকের ব্যাগ ও পলিথিন দিয়ে নিজেরাই জোংরা তৈরি করে ব্যবহার করতাম। গ্রামে তখন মানুষে পলিথিন বেশি চিনত না। তারা পলিথিনকে বলত সারের কাগজ। ইউরিয়া সারের বস্তার ভিতর যে সাদা পলিথিনের প্যাকেট থাকত তাকে গ্রামের সাধারণ মানুষ সারের কাগজ বলত।
উজিরপুর উপজেলার কাজিরা গ্রামের কৃষক মুনসুর বয়াতি বলেন, বর্তমানে (২০২৫ সাল) প্রত্যেক পরিবারে জনপ্রতি বাহারি রঙের ছাতা ব্যবহার করছে। তবে এক সময় গ্রামে ছাতার বিকল্প হিসেবে জোংরার ব্যবহার ছিল। বর্তমান প্রজন্ম এক সময়ের অতি প্রয়োজনীয় জোংরা নামে কোনো কিছু ছিল বা আছে তা জানে না। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো জোংরা নাম একেবারে মুছে যাবে যা আর কোনো দিন কেউ চিনবে না।
ছবি: খোলা কাগজ
লেখক, কবি ও গবেষক জয়শ্রী গ্রামের মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘একসময়ের জোংরা উজিরপুর থেকে হারিয়ে গেছে। তার জায়গায় এসেছে রেইনকোট, ফোল্ডিং ছাতা, পলিথিন দিয়ে তৈরি জামা। আমাদের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য তালপাতা ও বাঁশের পাতি বা চেড়া দিয়ে বানানো জোংরা পুরোনো দিনের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।
বামরাইল ইউনিয়নের দক্ষিণ মোড়াকাঠি গ্রামের তোফাজ্জেল হোসেন সরদার জানান, এলাকায় তালগাছের সংখ্যা অনেক কমে যাওয়ায় পাতা সংগ্রহ করাটা এখন বেশ কষ্টকর। চাষিরা পলিথিনের তৈরি রেইনকোট পরে হাটে-মাঠে যান। জোংরা বা জোমরা শব্দটিই অনেকে ভুলে গেছে। মাঠে বর্ষার সময় কৃষি কাজের জন্য খুবই উপযোগী ছিল জোংরা। সাম্প্রতিক সময়ে এর ব্যবহার নেই বললেই চলে।
ওটরা ইউনিয়নের একসময়ের কৃষক সারোয়ার মোল্লা জানান, আমি এখন পেশা পরিবর্তন করে হোটেল ব্যবসা করছি। আমরা বর্ষার সময় এ বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি যেতে জোংরা মাথায় দিয়ে যেতাম। কখনো কখনো হাটেও যেতাম। এলাকায় এখন আর জোংরা কেউ বানায় না। তাই চোখেও পড়ছে না। হারিয়ে যাচ্ছে উজিরপুরের গ্রামীণ ঐতিহ্য জোংরা বা কৃষকের ছাতা।