বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের দত্তপাড়া গ্রামে অবস্থিত সাতানি জমিদার বাড়ি বাংলাদেশের এক সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক নিদর্শন। কালের সাক্ষী এই জমিদার বাড়িটি শুধু একটি পুরনো ভবন নয়, এটি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের এক অনন্য প্রতীক। যারা ইতিহাস ভালোবাসেন, কিংবা অদেখা বাংলার নিদর্শন খুঁজে বেড়াতে চান, তাদের জন্য এটি এক অনন্য গন্তব্য।
বরিশালের পূর্বে কীর্তনখোলা নদী ও পশ্চিমে মায়াবী সন্ধ্যা নদী অবস্থিত। এই সন্ধ্যা নদীর তীরবর্তী স্থানেই সাতআনি (সাতানি) জমিদার বাড়ি অবস্থিত। স্থানীয় লোকজন এই জায়গাটাকে সাতানি মন্দির এলাকা হিসেবে চিনে, আবার অনেকে একে দত্তপাড়া জমিদার বাড়ি হিসেবেও চিনে থাকেন। প্রায় ২২ একর বাড়িটিতে ২৪টি দালান রয়েছে। বর্গীদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এখানে দুইটা আকর্ষণীয় দালান নির্মাণ করা হয়েছিল। দালান দুইটিতে একটি দরজা ও দুইটি জানালা দেখা যায়। বালাখানা নামে একটি দালান ছিল সেখানে। নায়েবরা বসতেন সেই বালাখানায়। ২৪টি দালানের মধ্যে কয়েকটি মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হতো। যেমন রাধামাধব মন্দির, দুর্গামন্দির ইত্যাদি।
আশ্চর্যজনক হলেও সেখানে একই মন্দিরে একসঙ্গে তিনটি দুর্গাপূজা হতো। মহিষ বলিদান হতো এবং পরে মহিষের পরিবর্তে ভোগ দেওয়া হতো। এ ছাড়া নারায়ণ ও মনসা মন্দিরও ছিল। দুর্গাপূজার সময় এই বাড়িতে যাত্রা, থিয়েটারসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতো। এখনও সেখানে ঐতিহ্য ধারণ করে পালন করা হয় সাতানির পার্শ্ববর্তী মন্দিরে ১০ হাত লম্বা কালীমাতার কালী পূজা।
সাতানিতে একটি পঞ্চম শ্রেণির স্কুল ছিল। ইন্দির আইচ নামে একজন নামকরা পণ্ডিত সে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন। এই স্কুলে নিমাচাঁদ চক্রবর্তী মহাশয়ও শিক্ষকতা করতেন। ধর্ম খার বংশের উত্তরসূরি মতিলাল ভৌমিক এ অঞ্চলের আলো ছড়ানো বিদ্যাপিঠ বাইশারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনারারি (বেতন নিতেন না) শিক্ষক ছিলেন। ভীম ভৌমিক ভারতবর্ষের একজন বিখ্যাত খোলবাদক ছিলেন। সেবার ব্রত নিয়ে সুনামের সাথে কাজ করে গেছেন ডা. লক্ষ্মীকান্ত ভৌমিক ও তার সহকর্মী ডা. সূর্য কান্ত সাহা। ডা. সূর্য কান্ত সাহার পুত্র ডা. উত্তম কুমার সাহা এখন বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ।
মুঠোফোনে উত্তম সাহা বলেন, ‘আমাদের পূর্ব পুরুষদের অনেকে মারা গেছেন, কেউ ভারতবর্ষে, কেউ ঢাকায় নানা দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। বহু বছর পূর্বে জমিদার বাড়িটি অর্পিত সম্পত্তি হয়, তবে সঠিক সাল জানা যায়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্থানীয় সবুর মেম্বার লিজ নিয়ে সাতানি জমিদার বাড়ির ঐতিহ্য গাছ-গাছালি কেটে নিয়ে যান। ডা. উত্তম সাহার কাকা শহীদ সৈনিক আদিত্য সাহার সমাধি রয়েছে এই জমিদার বাড়িতে। যিনি শান্তি বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে বান্দরবনের রামুতে শহীদ হন। বেদখলের কারণে সমাধি মন্দিরটি ভেঙে ফেলা হয়েছে।’
উত্তম সাহা সরকারের কাছে দাবি জানান, আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহ্যবাহী এই জমিদার বাড়ির অর্পিত বা দখলকৃত সম্পত্তি যেনো মূল মালিকদের প্রত্যর্পণ (ফিরিয়ে দেন) করা হয় এবং সরকার যদি লিজ দেয়, তাহলে যেন আসল মালিকদের দেওয়া হয়।
২৭ বার কারাবরণকারী বিপ্লবী কুমুদ বিহারি গুহ ঠাকুরতা প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সার্বজনীন মন্দিরের সভাপতি দেবাশীষ দাস বলেন, ‘সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের বানারীপাড়া মূলত সমৃদ্ধ হয়েছিল এসব ঐতিহ্যবাহী বাড়ি এবং তাদের শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশের কর্মকাণ্ডের জন্য। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এ সব বাড়ির উত্তরাধিকারদের একটু করে হলেও শিখরের সাথে সংযুক্ত থাকা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এছাড়া স্থানীয় জনসাধারণের সম্পৃক্ততায় দুর্গাপূজা চালু করা গেলে এবং এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে আমরা সাধুবাদ জানাবো।’
স্থানীয় বাসিন্দা বরিশাল বেতারের ঘোষক, বাচিক শিল্পী, শিক্ষক ও প্রবন্ধকার বিশ্বনাথ রায় বলেন ‘দত্তপাড়া জমিদার বাড়িটি ঐতিহাসিক নিদর্শন স্বরূপ। এই অমূল্য সম্পদ সংরক্ষণ সময়ের দাবি। আসুন, সকলে এ ব্যাপারে মনোযোগী হই।’
দত্তপাড়া সাতানি জমিদার বাড়ি আসার জন্য ব্রিজ পার হলেই যেটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তা হলো একটি সহমরণ সমাধিক্ষেত্র, যা ভারতবর্ষের সহমরণ প্রথার সাক্ষী হয়ে আছে।
একসময়ের ঘনবসতিপূর্ণ বাড়িটি আজ নীরব। মনে হয়, মুকুটটা পড়ে আছে শুধু রাজা নেই! চামচিকা, সাপ, কাঠবিড়ালি, বেজি ও বিভিন্ন প্রজাতির পোকামাকড়, বড় বড় লতা-গাছ-গুল্ম ও ঘন জঙ্গলকে ধারণ করে দালানগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরিত্যক্ত দালান ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মেলবন্ধনে সাতানি জমিদার বাড়ি এখন পরিপূর্ণ। পূর্বে যারা বসবাস করত, তারা এখন আর এই বাড়িতে আসে না।
এলাকাবাসী আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমরা কি পারি না ইতিহাসের সাক্ষী এই সাতানিকে আরও সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতে?’
সময়ের প্রবাহে বিলুপ্ত হয়ে গেছে জমিদারি প্রথা। হারিয়ে গেছে জমিদারদের প্রতাপ। কিন্তু মুছে যায়নি তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তেমনই ইতিহাস-ঐতিহ্যর সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে বানারীপাড়া উপজেলার বাইশারীতে ২৪ টি দালানের ঐতিহাসিক সাতানি জমিদার বাড়ি।
ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের ঘুরে বেড়ানোর কোনো কারণ লাগে না। সময় পেলেই বেড়িয়ে পড়েন, সেইসঙ্গে ইতিহাস হাতড়ে বেড়ান জানার উদ্দেশ্যে। সারাবিশ্বে ইতিহাস সাক্ষী এমন স্থানের জায়গা কম নয়। সেই তালিকায় পিছিয়ে নেই আমাদের দেশও। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাক্ষী এসব স্থান আজও অপেক্ষায় ভ্রমণপিপাসু মানুষের।
তাই, সুযোগ পেলেই দেখে আসুন দেশের (কালের সাক্ষী) ঐতিহ্যবাহী কিছু জমিদার বাড়ি। প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী ও শৈল্পিক কারুকাজে এসব জমিদার বাড়ি আজও কালের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ভরপুর।
ইতিহাস-ঐতিহ্যসমৃদ্ধ বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার সাতানি জমিদার বাড়িটি যুগ-যুগ ধরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দূরদূরান্ত থেকে এটি দেখতে আসেন বহু পর্যটক। অনেকে ভবনের ভেতরে-বাইরে ছবি তোলেন। সংষ্কার করলে এটি একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে বাস, বিমান কিংবা লঞ্চে বরিশাল আসতে হবে। এরপর বরিশাল নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে বানারীপাড়া আসতে হবে। বানারীপাড়া সন্ধ্যা নদীর খেয়া পার হয়ে একটু সামনেই দেখা মিলবে এই নিদর্শনটির।
কেকে/এমএ