বিভাগীয় জেলা শহর বরিশাল দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সর্বাধিক ঐতিহাসিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ। অগণিত নদী-নালা, খাল-বিল ও সবুজ বেষ্টনী ঘেরা বরিশালে জন্মেছেন ও বেড়ে উঠেছেন বহু গুণীজন। চন্দ্রদ্বীপ রাজারা এখানে প্রায় ২০০ বছর শাসন করে ছিলেন। বরিশালের মাধবপাশা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এখনও বহু রাজার বাসভবনের ভগ্নাবশেষ রয়েছে। মাধবপাশার নয়নাভিরাম দুর্গাসাগর দীঘি সেই রাজাদেরই এক কীর্তি। জনশ্রুতি ও তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে এই দীঘিটি খনন করেন তৎকালীন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের পঞ্চদশ রাজা শিব নারায়ন রায়। বাংলায় বারো ভূইয়ার একজন ছিলেন তিনি। স্ত্রী দুর্গাবতীর প্রতি ভালোবাসার গভীরতা প্রমাণের জন্যই নাকি তিনি রাজকোষ থেকে ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে দীঘিটি খনন করান।
কথিত আছে, রানী দুর্গাবতী একবারে যত দূর হাঁটতে পেরেছিলেন, ততখানি জায়গা নিয়ে এ দীঘি খনন করা হয়েছে।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, এক রাতে রানী প্রায় ৬১ কানি জমি হেঁটেছিলেন। রানী দূর্গাবতীর নামেই দীঘিটির নামকরণ করা হয় দুর্গাসাগর দীঘি।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দীঘিটি ৪৫ একর ৪২ শতাংশ জমিতে অবস্থিত। এর ২৭ একর ৩৮ শতাংশ জলাশয় এবং ১৮ একর ৪ শতাংশ পাড় । পাড়টি উওর-দক্ষিনৈ লম্বা ১ হাজার ৪৯০ ফুট ও প্রশস্ত পূর্ব পশ্চিমে ১ হাজা র৩৬০ ফুট।
কালের বিবর্তন ধারায় দীর্ঘিটি তার ঔজ্জ্বল্য কিছুটা হারিয়েছে—এ কথা সত্যি। তবে প্রতি শীত মৌসুমের শুরুতে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে এখানে নানা প্রজাতির পাখি আসে । সরাইল ও বালিহাঁসসহ নানা প্রজাতির পাখি দীঘির মাঝখানে ঢিবিতে আশ্রয় নেয়। সাঁতার কাটে দীঘির স্বচ্ছ, স্ফটিক পানিতে। কখনো বা হালকা শীতের গড়ানো দুপুওে ঝাকঁ বেঁধে ডানা মেলে দেয় আকাশে। সময়ের সাথে সাথে দীঘিটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় ইংরেজ শাসনামলে তৎকালীন জেলা বোর্ড এটি সংস্কার করে ।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে দীঘিটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময়েই দীঘির মাঝামাঝি স্থানে অবকাশ যাপন কেন্দ্র নির্মাণের জন্য মাটির ঢিবি তৈরি করা হয়। দীঘির চারপাশে নারিকেল ,সুপারি, শিশু ও মেহগনি প্রভৃতি গাছ রোপণ করে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়; যা বর্তমানে দীঘিটির শোভা বর্ধন করে চলছে। দীঘির চার পাশে চারটি সুদৃশ্য বাধানো ঘাট থাকলেও পূর্ব-দক্ষিণ পাশের ঘাট দুইটি বিলীন হয়ে গেছে। পশ্চিম পাড়ে ঘাট সংলগ্ন স্থানে রয়েছে জেলা পরিষদের ডাক বাংলো। ইচ্ছা করলে ভ্রমনকারীরা এখানে রাত কাটাতে পারেন ।
বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা এলাকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর দীঘিতে বছরজুড়েই থাকে প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের আনাগোনা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেহ-মনে প্রশান্তি এনে দেবে। দিঘির চারপাশের গাছপালার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন, কোথায় মন যে হারিয়ে যাবে, তা বুঝে ওঠাই কঠিন।
তারপর দীঘির জলে পা ভেজানোর আনন্দটা তো থাকছেই। সব মিলিয়ে ক্লান্তিহীন, শীতল আবহে যেনো মন জুড়িয়ে যায় এখানটায়।
এদিকে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটকদের কাছে দীঘিটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে কাজ করেছে স্থানীয় প্রশাসন। বর্তমানে দুর্গাসাগরে ছয়টি হরিণ রয়েছে।
দীঘির জলে ডানা ঝাপটে ভাসতে দেখা যাবে রাজা হাঁস ও পেচি হাঁস। তবে ভাগ্য ভালো হলে ডাহুক ও পানকৌড়ির দেখাও মিলতে পারে দীঘির পাড়ে। যদিও দীঘি কেন্দ্রীক পাখিদের আনাগোনা বাড়ানোর জন্য সম্প্রতি কৃত্রিমভাবে গাছে গাছে বসানো হয়েছে বাসা। কিন্তু, হরহামেশা বিলুপ্ত প্রায় নানা পাখির ডাক শোনার পাশাপাশি দেখাও মেলে এখানে।
বরিশাল শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তরে বরিশাল-বানারীপাড়া আঞ্চলিক সড়কের পাশে বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের মাধবপাশা গ্রামে ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর দীঘির অবস্থান। বরিশাল নগরের নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে বাস বা যাত্রীবাহী থ্রি-হুইলার (মাহিন্দ্রা)-এ চরে আধঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছানো যায় দুর্গাসাগর দীঘিটিতে।
দুর্গাসাগরে আসা ভ্রমণকারীরা জানান, দীঘিটি আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে হওয়ায় বাস বা থ্রি-হুইলার থেকে নামতেই দীঘির প্রবেশ পথের দেখা মিলবে। ১০ টাকার টিকিটের বিনিময়ে ঢুকে যতোটা সময় মন চায় থাকা যাবে দিঘির পাড়ে।
প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ অধিদফতরের পরিবর্তে দুর্গাসাগর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে জেলা প্রশাসন। দুর্গাসাগরের তিন দিকে ঘাটলা ও দীঘির ঠিক মাঝখানে ৬০ শতাংশ ভূমির উপর টিলা।
দীঘির জলাভূমির আয়তন ২৭ একর। এর চারপাশে রয়েছে বিভিন্ন বৃক্ষ শোভিত বন। সবমিলিয়ে দুর্গাসাগরের আয়তন ৪৫ দশমিক ৪২ একর। দীঘির মধ্যখানে রয়েছে গাছ-গাছালিতে ছায়া দৃষ্টিনন্দন একটি দ্বীপ। ১৯৭৪ সালে তৎকালীন সরকারের উদ্যোগে দীঘিটি পুনরায় সংস্কার করা হয়।
সম্পূর্ণ দীঘিটি উঁচু সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেড়া। দুই দিকে প্রবেশের জন্য দুইটি গেট থাকলেও একটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। চৈত্রমাসের অষ্টমী তিথিতে হিন্দু ধর্মালম্বীরা এখানে স্নানের উদ্দেশ্যে সমবেত হন।
পূণ্য লাভের আশায় স্নান করতে আসা বরিশাল নগরের মুন্সিগ্রেজ এলাকার পাপড়ি রানি বৈদ্য বলেন, ‘গত এক যুগ ধরে এ অষ্টমী তিথির দিনে পূণ্য লাভের আশায় স্নান করছি। ব্রহ্মা দেব ও গঙ্গা দেবীর কৃপা লাভ করাই মূল উদ্দেশ্য।’
দুর্গাসাগর দীঘিতে গিয়ে দেখা গেছে, প্রকৃতি যেন তার সবটুকু সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে। দীঘির দক্ষিণ দিকের বিশাল অংশ জুড়ে দেখা মেলে শ্বেতপদ্মের। বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে যেন পদ্মের সমাহার।
দুর্গাসাগর দীঘির কেয়ারটেকার তপন লাল লস্কর বলেন, ‘প্রাকৃতিকভাবে এ বছরই প্রথম জন্ম নিয়েছে শ্বেতপদ্ম। বর্ষার শুরুতেই দীঘির বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে ফুটেছে সাদা রংয়ের পদ; যা দেখলে মন-প্রাণ আর চোখ জুড়িয়ে যায়। পাপড়ি মেলে প্রকৃতি প্রেমীদের স্বাগত জানায় জলজ ফুলেল রাণী পদ্ম। এমন দৃশ্য উপভোগ করতে প্রতিদিন পর্যটক আসছে দুর্গাসাগরে।’
তপন লাল লস্কর জানান, বরিশালের জেলা প্রশাসক স্যারের নানা পদক্ষেপের কারণে দুর্গাসাগরে পর্যটকের সংখ্যাও বেড়েছে। তিনি দুর্গাসাগরে পাখির অভয়ারণ্য অবমুক্ত করেছেন। দীঘিতে মাছ ও হাঁস ছেড়েছেন। বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টিতে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয় করে বর্তমানে বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।