গ্রামীণ কৃষিজীবনের একসময়কার অপরিহার্য অংশ ছিল দোন ও সেঁউতি। যার সাহায্যে পুকুর বা ডোবা নালা থেকে পানি উঠায়ে উচু জায়গার জমি দিতেন চাষীরা। ফলাতেন সোনালী ফসল। তবে বর্তমানে বিদ্যুৎচালিত পাম্প আর ডিজেল ইঞ্জিনের আগমনে সেই ঐতিহ্যবাহী সেচযন্ত্র এখন প্রায় হারিয়ে গেছে। হাতে চালিত সেচযন্ত্র এখন শুধু অতীতের স্মৃতি।
দোন বা দোনকল হচ্ছে বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষিতে ব্যবহৃত একধরনের সেচযন্ত্র যা বাঁশ, কাঠ, দড়ি ও মাটির পাত্র বা বালতি দিয়ে তৈরি করা হতো। এটি দিয়ে নদী, খাল বা পুকুর থেকে পানি তুলে ফসলের জমিতে দেওয়া হতো অপরদিকে সেঁউতি বা সেঁউচি হলো দোলনা আকৃতির লিভার-ভিত্তিক যন্ত্র যার এক পাশে পানি তোলার পাত্র এবং অপর পাশে ভারসাম্য রাখার ওজন থাকত। দোনকল চালাতে লাগতো দুয়ের অধিক লোক তবে একজন ব্যক্তিই চালাতে পারতো সেঁউতি। উভয়টিই গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সেচব্যবস্থার চমৎকার উদাহরণ ছিল।
শালিখা উপজেলার আড়পাড়া, বুনাগাতী, গঙ্গারামপুরসহ অনেক অঞ্চলেই একসময় দোন-সেঁউতি ছাড়া ফসলি জমিতে সেচ দেওয়ার কল্পনাই করা যেত না। ভোরবেলা কিংবা বিকালের দিকে কৃষকেরা দল বেঁধে যেতেন খাল বা নদীর ধারে। কেউ চালাতেন দোন, কেউ টানতেন সেঁউতি। দোলনার মতো নড়াচড়া করে এই যন্ত্রগুলো খাল বা পুকুর থেকে পানি তুলে জমিতে ঢালত। দোন তৈরি হতো একটি লম্বা বাঁশ বা কাঠের দণ্ড দিয়ে। এক প্রান্তে থাকত পানি তোলার পাত্র, অন্য প্রান্তে ভারসাম্যের জন্য ভারী বস্তু। এক ব্যক্তি সহজেই এটি চালাতে পারতেন। অন্যদিকে সেঁউতি ছিল কিছুটা বড় এবং ঝুলন্ত দোলনার মতো কাঠামো, যা সাধারণত দুইজন মানুষ পা দিয়ে চালাতেন।
এখন গ্রামে এসব যন্ত্রের দেখা মেলে না বললেই চলে। উপজেলা সদর আড়পাড়া ইউনিয়নের পুকুরিয়া গ্রামের প্রবীণ কৃষক শুকুর বিশ্বাস বলেন, আগেকার দিনে একনকার মতো এতো বেশি মেশিন বা মটর ছিলনা। তাই আমরা দোনে পানি তুলে জমি ভরতাম। এখন মেশিনে সব হয়, কিন্তু সেই সময়ের আনন্দ আর একতার জায়গা এখন আর নেই।
বুনাগাতী ইউনিয়নের দেশমুখপাড়া গ্রামের কৃষক লুৎফর বিশ্বাস বলেন, আমাদের সময়ে দোন বা সেঁউতি দিয়ে খাল বা নদী থেকে পানি উঠায়ে পাতোর ভুঁইতে (বীজতলা) দিতাম। একজনের তা হয়ে গেলে আরেকজনের জমিতে যেতাম। তবে অনেক পানির প্রয়োজন হলে দিনভর পানি উঠাতে হতো। কাজটি পরিশ্রমের হলেও আমরা সকলে মিলে বেশ আনন্দ করতাম।
দোন–সেঁউতি কেবল সেচযন্ত্র নয়, এটি গ্রামীণ জীবনের এক ঐতিহ্য। অনেক তরুণ কৃষক জানেই না তাদের পূর্বপুরুষ কীভাবে জমিতে পানি দিতেন। তাই এগুলো সংরক্ষণ করা গেলে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে, প্রযুক্তির আগেও কেমন দক্ষতা ও পরিশ্রমে কৃষকরা জমিতে সেচ দিতেন। বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মাগুরাখামারবাড়ির অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) কৃষিবিদ আলমগীর হোসেন বলেন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এর ফলে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন কৃষিযন্ত্র দোন-সেঁউতি। বিজ্ঞান প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতায় আধুনিকায়নের ফলে যন্ত্র সভ্যতার যাঁতাকলে এখন বিলুপ্ত একসময়ের জনপ্রিয় এসব সেচযন্ত্র। একসময় গ্রাম বাংলার কৃষিতে ব্যাপক চাহিদা থাকলেও আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি আবিস্কারের ফলে দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে কাঠের দোন ও টিনের সেউতিসহ অন্যান্য চিরচেনা কৃষি উপকরন সামগ্রী। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রাচীন কৃষি উপকরণের সাথে পরিচিতি করে দেয়ার জন্য হারিয়ে যাওয়া এসকল কৃষি যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন।
চিরচেনা এই যন্ত্রগুলো আজ হারিয়ে গেলেও, সেসব দিনের স্মৃতি রয়ে গেছে কৃষকের ঘামে ভেজা মাটির গন্ধে।
কেকে/ এমএস