সাতৈর শাহী মসজিদ শত শত বছর ধরে ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদটি ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর গ্রামে অবস্থিত। এটি প্রায় ৭০০ বছর আগের নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের আমলে নির্মিত।
বর্গাকার এই মসজিদটি বাইরের দিক থেকে ১৭ দশমিক ৮ মিটার এবং ভেতরের দিক থেকে ১৩ দশমিক ৮ মিটার।
কথিত আছে, ভূমি থেকে মসজিদটির মেঝে প্রায় শুন্য দশমিক ৭৬ মিটার উঁচু ছিল, বর্তমানে এটি শুন্য দশমিক ৬ মিটার উঁচু। মোট ৯টি কন্দ আকৃতির গম্বুজ রয়েছে। মসজিদটির ভেতরে পাথরের তৈরি চারটি স্তম্ভ, দেয়ালে ও দেয়ালের গা সংলগ্ন মোট ১২টি পিলার রয়েছে। গম্বুজগুলো পেন্ডেন্টিভ পদ্ধতি ব্যবহার করে নির্মাণ করা হয়েছে। আরব দেশীয় মসজিদগুলোর মতো মোট তিনটি মেহরাব আছে, যার কেন্দ্রটি তুলনামূলকভাবে বড়।
তবে নির্মাণের শুরুতে পশ্চিম দিক ছাড়াও মসজিদের তিনটি প্রবেশ পথ থাকলে বর্তমানে মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ দিকের প্রবেশ পথ জানালায় রূপান্তর করা হয়েছে। সাতৈর শাহী মসজিদের পাশে আছে ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড, বারো আউলিয়ার মাজার। মসজিদ নির্মাণের পর থেকে স্থানীয়দের মাঝে মসজিদ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের লোককথা প্রচালন আছে।
অনেকে অনুমাননির্ভর তথ্য দিয়ে বিভিন্ন মুঘল সম্রাটের নামের সঙ্গে মসজিদটির নাম যুক্ত করতে চেয়েছেন। তবে সঠিক দলিল পেশ করতে পারেননি কেউ।
এ ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় ভূষণা রাজ্যের ইতিহাস গ্রন্থের রচয়িতা কবি সমর চক্রবর্তীর কাছ থেকে। ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তিনি জানান, এটি নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের আমলে নির্মিত। ঐতিহাসিক সাতৈর নগরী এখন অবহেলিত জনপদ হলেও বাংলার সুলতানি আমলে ভূষণা রাজ্যের সুপ্রাচীন নৌবন্দর ও প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল সাতৈর ও তার আশপাশের এলাকা। এ মসজিদের পাশ ঘেঁষেই গেছে ঐতিহাসিক গ্রান্ড ট্রাংক রোড। কেউ কেউ মনে করেন, সাতৈর শাহী মসজিদটি শের শাহের আমলের স্থাপনা।
তবে, ঐতিহাসিক মতবিরোধ যা-ই হোক, মসজিদটি আশপাশে কবরে শায়িত ইসলাম ধর্মপ্রচারক আউলিয়াদের সম্মানের প্রতীক হিসেবে নির্মিত হয়েছিল এ বিষয়ে সবাই একমত।
আজও সাতৈর শাহী মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় যেসব ধর্ম প্রচারকের কবর বিদ্যমান, তারা হলেন হযরত জালাল শাহ বাগদাদী (রহ.)। মসজিদের পূর্ব পাশের মৌলভী বাড়ির ভিটায় বিদ্যমান; হযরত জায়েদ শাহ বাগদাদী (রহ.); হযরত বোখারী শাহ বাগদাদী (রহ.); হযরত সুফী বুট্টি শাহ্ বাগদাদী (রহ.); হযরত শাহ মইজউদ্দিন তেগ বোরহানি ইয়েমানি (রহ.); হযরত শাহ সুফী মুছি হাক্কানী (রহ.); হযরত শায়েখ শাহ আলী ছতরী (রহ.)।
হযরত শায়েখ শাহ আলী ছতরী (রহ.): তিনি চতুর্দশ শতকে এদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন বলে অনুমিত হয়। ইসলাম প্রচারের জন্য তিনি সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। হযরত শায়েখ শাহ আলী ছতরীর (রহ.) কামালিয়্যাত ও ত্যাগী জীবনযাত্রায় আকৃষ্ট হয়ে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তার কাছে মুরিদ হয়েছিলেন বলে অনেক ঐতিহাসিক দলিল পেশ করেছেন।
হযরত শাহ কলিমুল্লাহ্ (রহ.) : মসজিদের দক্ষিণ পাশে প্রচীনকালের ছোট ছোট ইটে বাঁধানো দুটো কবর রয়েছে। একটি হযরত শাহ কলিমুল্লাহর (রহ.) কবর, অপরটি হযরত মইজউদ্দিন কানী শাহর (রহ.)। মসজিদের পূর্বপাশে রয়েছে হযরত শাহ কলিমুল্লাহর (রহ.) ভাই হযরত লাল শাহর (রহ.) কবর।
হযরত আবদুল্লাহিল কাফী (রহ.) ও হযরত আবদুল্লাহিল সাফী (রহ.) দুই ভাইয়ের মাজার সাতৈরের কাছে ধোপাডাঙ্গা গ্রামে অবস্থিত। মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) শায়খ আবদুল্লাহিল কাফী (রহ.) ও তার ভাই ইসলাম প্রচারের জন্য এ এলাকায় আসেন। তারা উভয়ে ওই এলাকায় ইসলামের বিস্তারে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় বহু লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
হযরত লাল শাহ (রহ.) ঐতিহাসিক সাতৈর শাহী মসজিদের পূর্ব পাশে শায়িত রয়েছেন।
হযরত মইজউদ্দিন কানী শাহ (রহ.)। মসজিদ সংলগ্ন দুটি বাঁধানো কবরের একটিতে এই ধর্ম প্রচারক শায়িত রয়েছেন।
হযরত উড়িয়ান শাহ (রহ.):
হযরত উড়িয়ান শাহর (রহ.) কবর দুধ পুকুরের উত্তর পশ্চিম দিকে অবস্থিত। হযরত উড়িয়ান শাহ (রহ.) দ্বাদশ শতকে বাংলায় ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন। তখনকার ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু-বৌদ্ধ অধ্যুষিত, বিরূপ ভাবাপন্ন এলাকায় ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে তিনি প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাকে অত্যন্ত বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে জিহাদের মাধ্যমে তৌহিদের ইসলাম প্রচার করতে হয়েছিল। আঞ্চলিক লোকগাঁথা থেকে জানা যায়, তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধর্মযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। তার মস্তকের কবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আর তার শরীরের বাকি অংশের কবর সাতৈরে বিদ্যমান।
সাতৈর শাহী মসজিদ কেবল একটি প্রাচীন স্থাপত্যই নয়, এটি বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল সাক্ষী। যথাযথ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে এই নিদর্শনটি আগামী প্রজন্মের জন্য তুলে ধরা জরুরি।
কেকে/ এমএ