ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দিল্লিতে পালিয়ে যান তিনি। শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার আগে-পরে তার আত্মীয়স্বজন, দলের শীর্ষ নেতা, সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, এমনকি সংসদ সদস্যরাও দেশ ছাড়েন। বাকিরা দেশের ভেতরেই আত্মগোপনে আছেন।
তবে পলাতক অবস্থায়ও বসে নেই পতিত আওয়ামী লীগের নেতারা। আওয়ামী শোকের মাস আগস্টে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে নতুন ছক কষছে ফ্যাসিবাদীরা। অন্তর্বর্তী সরকার হটাতে তৈরি করা হচ্ছে ভয়াবহ নাশকতার ছক। বিভিন্ন দেশে পলাতক মুজিববাদী নেতাকর্মী এবং আমলা, সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের সাবেক কর্মকর্তাদের দিয়ে আঁটা হচ্ছে কূটকৌশল।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে কর্মসূচি পালনকালে ফ্যাসিবাদী শক্তি অনলাইন-অফলাইনে প্রচারণা চালিয়ে সারা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। একইসঙ্গে ৫ আগস্টকে সামনে রেখে দেশজুড়ে অস্থিরতা ও সহিংসতা ছড়ানোর চক্রান্তের পরিকল্পনাও চলছে বলে আশঙ্কা করছে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)।
গত সোমবার এসবির এক প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনটি পুলিশের সব বিভাগকে পাঠিয়ে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছে এসবি। এসবির একটি সূত্র এই প্রতিবেদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঐতিহাসিক জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ফ্যাসিবাদবিরোধী সামাজিক সংগঠনগুলো ১ জুলাই থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত কর্মসূচি পালনের সময়কাল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে কর্মসূচি পালনকে কেন্দ্র করে বিতাড়িত ফ্যাসিবাদী শক্তি অনলাইন-অফলাইনে প্রচারণা চালিয়ে দেশব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টি, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির কর্মসূচিতে বাধা প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপচেষ্টা চালাতে পারে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাসহ সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তি ও জানমাল রক্ষায় পুলিশের বিভিন্ন বিভাগকে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছে এসবি।
নির্দেশনাগুলো হলো- ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা। ৮ আগস্ট পর্যন্ত নিয়মিত সন্দেহজনক ব্যক্তিসহ মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস ও অন্যান্য যানবাহন তল্লাশি করা। বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশন ও বিমানবন্দরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল অভিযান পরিচালনা করা। মোবাইল প্যাট্রোল জোরদার করা। গুজব রোধে সাইবার পেট্রোলিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখাসহ গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা। এ ছাড়া কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকলে তা তাৎক্ষণিকভাবে এসবিকে অবহিত করার কথাও বলা হয়েছে।
সূত্র বলছে, ৫ আগস্ট ঘিরে একযোগে সাইবার এ্যাটাক করার পরিকল্পনা করছে পতিত আওয়ামী লীগ। নেতাকর্মীদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ছদ্মবেশে ঢুকে পড়া, তাদের ঐক্য নষ্ট করা, জনমনে ক্ষোভ উসকে দেওয়া; ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ব্যাপকভাবে স্পর্শকাতর প্রসঙ্গে গুজব কিংবা অপপ্রচার চালানোর নির্দেশ রয়েছে পতিত দলটির শীর্ষপর্যায় থেকে।
এই অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে কার্যত নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। কখনো প্রকাশ্যে, আবার কখনো নেপথ্যে থেকে তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছেন।
পলাতক নেতাদের কাছ থেকে নির্দেশ এসেছে যে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোনোভাবেই স্বাভাবিক থাকতে দেওয়া যাবে না এবং যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলে তার সুযোগ নিতে হবে। এই নির্দেশের পর দলীয় কর্মীরা এরই মধ্যে মাঠে নেমেছেন এবং বড় ধরনের নাশকতার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। একইসঙ্গে, তারা যৌক্তিক-অযৌক্তিক আন্দোলনে আন্দোলনকারী সেজে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছেন।
এদিকে শেখ হাসিনা নিজেই নিয়মিত অডিও বার্তা দিচ্ছেন। আত্মগোপনে থাকা কর্মীদের সাহস জোগাচ্ছেন। তিনি ‘অচিরেই দেশে ফিরবেন’ -এমন ঘোষণা দিয়ে তাদের মাঠে নামার নির্দেশ দিচ্ছেন। দিল্লিতে বসেই হরতাল-অবরোধ-বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করছেন। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের বিদেশবিভুঁইয়ে বিলাসী জীবনযাপন করা নেতাদের কথায় দেশে থাকা নেতাকর্মী-সমর্থকরা রাজনীতির ফাঁদে পা দিয়ে হুটহাট মাঠে নামছেন, রাজপথে ঝটিকা মিছিল করছেন। তবে পুলিশসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের কঠোর পদক্ষেপে তারা এখন পর্যন্ত খুব একটা সফল হতে পারেননি। এ অবস্থায় রণকৌশলে পরিবর্তন এনেছে আওয়ামী লীগসহ দলটির বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন। যদিও আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড এখন নিষিদ্ধ। এছাড়াও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকেও। তবুও বসে নেই তারা, নানা উপায়ে দেশকে অস্থিতিশীল রাখতে নিত্যনতুন পথ বেছে নিচ্ছেন ক্ষমতাচ্যুতরা।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দলীয় ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। ভারতে বসে এ নীলনকশা প্রস্তুত করছেন শেখ হাসিনা। জুলাই বিপ্লবের বর্ষপূর্তি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি করা প্রতিবেদনেও মিলেছে উদ্বেগজনক এ তথ্য।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের মাথাচাড়া দেওয়ার গোয়েন্দা তথ্য সামনে আসতেই ব্যাপক ক্ষোভ জানিয়েছেন নেটিজেনরা। এক বছরেও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের নির্মূল করতে না পারায় কঠোর সমালোচনা করেছেন সচেতন নাগরিকরা।
সূত্র জানায়, গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামী ৫ আগস্ট। সেদিন দেশ দখলের স্বপ্ন দেখছে আওয়ামী লীগ। অস্থিরতা তৈরি করতে ঢাকা ও দিল্লিতে চলছে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। এছাড়া গোপালগঞ্জকে সন্ত্রাসীদের অভয়াশ্রম ধরে সেখানে প্রস্তুত করা হচ্ছে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র।
এর আগেও উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ফায়দা লোটার চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ। হতাহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে চালিয়েছিল নানা ধরনের অপপ্রচার। কোমলমতি শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সাধারণ মানুষকে উসকে দিয়েছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে। ‘টুঙ্গিপাড়ায় কবর ভাঙা হবে’ -এমন অপপ্রচার চালিয়ে গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষকে উসকে দিয়ে সহিংসতা ঘটিয়েছে দলটি। এছাড়া গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি বলে বিবেচিত বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কয়েকদিন ধরে যে অনৈক্য তৈরি হয়েছে, এ সুযোগটিকেও নিজেদের মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে কার্যত নিষিদ্ধ ওই দলটি।
কেকে/ এমএস