পণ্যে মাত্রারিক্ত শুল্ক কমিয়ে আনতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা আজ যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝানোর মিশনে নামছে। ১ আগস্ট থেকে মার্কিন শুল্ক আরোপ হবে বলে এটাই বাংলাদেশের শেষ সুযোগ। এরই মধ্যে শুল্কে ছাড় পেতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যয়বহুল উড়োজাহাজসহ বিশাল আমদানি ঘোষণা দিয়েছে। আর এবার বাংলাদেশ অনেক সতর্ক, তারা তথ্য ও তত্ত্বে এবং উপস্থাপনায় সমৃদ্ধ হয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। ছক ও যুক্তি চূড়ান্ত করতে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি এবং অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ নিয়েছে। একটা ভালো ফল আশা করছে বাংলাদেশ ও দেশের জনগণ।
যুক্তরাষ্ট্রে আজ বৈঠক বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের:
মার্কিন শুল্ক নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা করতে আজ যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা ওয়াশিংটনে বসছে। বাংলাদেশ দলে রয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও বিষয়ক মহাপরিচালক ড. নাজনীন কায়সার চৌধুরী।
এবার যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করে গেছে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। তারা ব্যবসায়ী-শিল্পপতি এবং অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে একাধিক দিন মিলিত হয়েছেন। বৈঠকে আলোচনা ছক ও কৌশল নিয়ে তারা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। প্রয়োজনীয় পরামর্শও দিয়েছেন অভিজ্ঞরা। সেই সঙ্গে দুই বৈঠকের অভিজ্ঞতা থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ডিজিটাল কনটেন্টও নিয়ে গেছেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। তথ্যভান্ডার, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ এবং যুক্তি-প্রমাণে এবার বাংলাদেশ সমৃদ্ধ।
চূড়ান্ত আলোচনার আগে ২৫টি বোয়িংয়ের অর্ডার:
যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ৩৫ শতাংশ পাল্টা-শুল্ক (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) কমাতে বাংলাদেশ যখন চূড়ান্ত আলোচনার প্রতীক্ষায়, এরমধ্যেই আমেরিকান এরোস্পেস জায়ান্ট বোয়িং থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার অর্ডার দিয়েছে সরকার। ওয়াশিংটনে গুরুত্বপূর্ণ এই বাণিজ্য আলোচনার আগে যেটিকে ‘ডিল সুইটনার’ বলে উল্লেখ করেছেন কর্মকর্তারা।
চূড়ান্ত আলোচনায় অংশ নিতে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রে রওনা দেন বাণিজ্য উপদেষ্টার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল।
২৯ ও ৩০ জুলাই ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের (ইউএসটিআর) কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় অংশ নেবেন তারা। ৩১ জুলাইয়েও দুপক্ষের মধ্যে একটি সভা হতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসন আরোপিত এই শুল্ক ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। বাংলাদেশের প্রত্যাশা, বোয়িং থেকে উড়োজাহাজ অর্ডার দেওয়া এবং সম্প্রতি অন্যান্য বাণিজ্যিক পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানিতে ভারত ও ভিয়েতনামের চেয়ে কম শুল্ক পেতে সহায়ক হবে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান ২৫টি বোয়িং উড়োজাহাজের অর্ডার দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান আলোচনার কৌশলেরই একটি অংশ। তিনি বলেন, ‘ভারত ও ভিয়েতনামও ট্যারিফ নেগোসিয়েশনের অংশ হিসেবে ১০০টি করে বোয়িং এয়ারক্রাফট এবং ইন্দোনেশিয়া ৫০টি কেনার অর্ডার দিয়েছে।’
ভিয়েতনামের উপর আরোপিত পাল্টা-শুল্ক ৪৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করার ঘোষণা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। আর ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ ট্যারিফ আরোপের প্রস্তাব করেছে দেশটি, যা কমাতে ভারত এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রত্যাশা ভিয়েতনাম বা ভারতের ওপর যে পরিমাণ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, তার চেয়ে বাংলাদেশের শুল্ক হার কম হবে। প্রতিযোগীদের চেয়ে আমাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র বাড়তি শুল্ক চাপিয়ে দেবে- এমন মনে করছি না।’
তবে সচিব জানান, বোয়িং অর্ডার এখনো মন্ত্রিসভার কমিটিগুলোর অনুমোদন পায়নি। কেনাকাটার জন্য অর্থনৈতিক বিষয়াবলি সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি এবং সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন।
‘আমরা অর্ডার দিয়েছি, কিন্তু কেনাকাটা চূড়ান্ত হয়নি। আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে,’ বলেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘আমরা বোয়িং এর এয়ারক্রাফট অর্ডার দিয়েছি। এখনো কিনি নাই। কেনার আগে আইন অনুযায়ী, এসব কমিটির অনুমোদন নেওয়া হবে। আমরা বোয়িংয়ের কাছে জানতে চেয়েছি, তারা কবে নাগাদ সরবরাহ করতে পারবে। কারণ, অনেক দেশ অর্ডার করেছে। তারা যে সময় সরবরাহ করতে পারবে, আমরা সেই সময় অনুযায়ী বাকি প্রস্তুতি সম্পন্ন করব।’
মাহবুবুর রহমান জানান, ‘বোয়িং কোম্পানি তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী সরবরাহ করবে। অর্ডারের বোয়িং পেতে অনেক সময় লাগবে। যে দেশ আগে অর্ডার দিয়েছে, তাদের আগে সরবরাহ করবে কিংবা প্রতিষ্ঠানটি তাদের ব্যবসার ধরন অনুযায়ী সরবরাহ করবে।’
‘বাংলাদেশের অতি দ্রুত কিছু উড়োজাহাজ দরকার। আগামী দু-এক বছরের মধ্যে হয়তো কিছু এয়ারক্রাফট পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ বিমানের বহর বাড়াতে হবে। এই পরিকল্পনা সরকারের আগে থেকেই ছিল। আগে ১৪টি বোয়িং কেনা হয়েছে। রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ ইস্যুতে ২৫টি অর্ডার করা হয়েছে’- বলেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব গতকাল বলেন, ‘বোয়িংকে বেছে নেওয়া হয়েছে কূটনৈতিক কৌশলগত কারণে। এর মানে এই নয় যে আমরা অন্যদের কাছ থেকে কিনব না।’ সমালোচকরা বলছেন, এটি বাণিজ্য কূটনীতি।
এভিয়েশন বিশ্লেষক এবং সাবেক উইং কমান্ডার এটিএম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এটা টোটালি মনে হচ্ছে রাজনৈতিক অ্যাপ্রোচ। ইউএসের সঙ্গে ট্যারিফ আলোচনার ভারসাম্য আনার জন্য একটা ট্রেড পলিটিক্স বলতে হবে। যেহেতু বিমান একটা সরকারি প্রতিষ্ঠান, অতীতেও আমরা দেখেছি তাদের ওপর এ ধরনের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’
বেশি দামে গম আমদানির সিদ্ধান্ত:
গত সপ্তাহে সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২.২ লাখ টন গম আমদানির অনুমোদন দিয়েছে, যার প্রতি টনের দাম ধরা হয়েছে ৩০২.৭৫ ডলার, যা বৈশ্বিক গড় মূল্য ২৪০ ডলার থেকে অনেক বেশি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের গমের দাম ছিল প্রতি টন ২২৫ ডলার, যেখানে রাশিয়া ও ইউক্রেনের গম আরো সস্তায় পাওয়া যাচ্ছিল।
এই চড়া দামে কেনাকে সমর্থন করে বাণিজ্য সচিব বলেন, সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৯০ লাখ টন গম আমদানি করে। কখনোই একটি দেশ থেকে এসব গম আনা হতো না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেও আমদানি হতো। কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের পরিস্থিতির কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা আগের মতো নেই। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার ওপর নির্ভরশীলতা রাষ্ট্রীয় স্বার্থেই প্রয়োজন। রাশিয়া, ইউক্রেন থেকে গম আনা হয়। কিন্তু তারা আমাদের কাছ থেকে তেমন আমদানি করে না।
সরকারি ক্রয় কমিটির চেয়ার ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ উচ্চমূল্যের বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, এটি বিস্তৃত বাণিজ্য আলোচনার কৌশলের অংশ। আমরা একটি ভারস্যমূলক অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করছি।
কেকে/এআর