গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের মুখে পতন ঘটে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের। আর এই আন্দোলনের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তবে এক বছর না যেতেই নানা গুরুতর অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে এই প্লাটফর্মের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা ব্যাপকভাবে চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সর্বশেষ রাজধানীর গুলশানে সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক এক এমপির বাসায় গিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে আটক হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাঁচ সমন্বয়ক। গত শনিবার তাদের আটক করে গুলশান থানা পুলিশ। এর আগে গত ১২ জুন চাঁদাবাজির অভিযোগে সাতক্ষীরায় সেনবাহিনীর হাতে আটক হন ৩ সমন্বয়ক। এ ছাড়া চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে জিয়াউর নামের এক সমন্বয়েকের চাঁদা দাবির অডিও ভাইরাল হয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে সক্রিয় থাকা অনেকের বিরুদ্ধেই গত বছর অগাস্টের পর থেকেই ক্ষমতা প্রদর্শন, চাঁদাবাজি, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুবিধা আদায়, সচিবালয়ে তদবিরসহ নানা অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে ঢাকাসহ সারা দেশে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ সারা দেশেই তীব্র আকার ধারণ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি ছাড়াও শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের সঙ্গে জড়িত অনেকের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ওঠছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক বলছেন, দৃশ্যমান কোনো দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণেই ‘সমন্বয়কের পরিচয়’ ব্যবহার করে মব তৈরি করে অর্থ আদায়ের প্রবণতা বেড়েছে। তার মতে, অর্থ আদায়ের জন্যই এসব পরিচয় ব্যবহার করা হচ্ছে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা অভিযোগ করেছেন- এসব চাঁদাবাজদের শেকড় অনেক গভীরে। এদের বিরুদ্ধে সংগঠন জেনেশুনেও চুপ থাকে।
গুলশানের ৮৩ নম্বর রোডে রাজধানীর গুলশান এলাকায় আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসা। গত ১৭ জুলাই সকালে সমন্বয়ক পরিচয়ে ওই বাসয় গিয়ে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন আব্দুর রাজ্জাক রিয়াদ। টাকা না দিলে ফ্যাসিস্টের দোসর বলে পুলিশে দেওয়ার ভয় দেখান তিনি। তখন তারা ১০ লাখ টাকা চাঁদা নিয়ে আসেন। পরে ফের গত শনিবার সন্ধ্যায় চাঁদার জন্য গেলে পুলিশ তাদের আটক করে থানায় নিয়ে আসে।
রিয়াদ ছাড়া অন্য আটকরা হলেন- মো. সিয়াম, সাদমান সাদাব, মো. আমিনুল ইসলাম ও ইব্রাহীম হোসেন। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আটকদের মধ্যে আব্দুর রাজ্জাক রিয়াদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের সদস্য। এ ছাড়া অন্যরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী।
গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক এমপির শাম্মী আহমেদের কাছে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে। ১০ লাখ টাকা আগে নিয়েছিলেন। গত শনিবার বাকি টাকা নিতে শাম্মী আহমেদের বাসায় গেলে পুলিশকে খবর দেয়। আমরা ওই বাসা থেকে পাঁচজনকে আটক করি।
যা বললেন সাবেক সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ৫ জনের চাঁদাবাজির খবর শুনে আমার পরিচিত ব্যক্তিবর্গ এতটাই আশ্চার্যান্বিত হওয়ার অভিনয় করছেন যে, আমার মনে হচ্ছে আমিই সব থেকে কম আশ্চর্য হয়েছি। এই ছেলেগুলাকে তো নেতাদের পেছনে প্রটোকল দিতে দেখা গেছে এতদিন ধরে। সচিবালয় থেকে শুরু করে মিছিল-মিটিং, মারামারি সব জায়গাতেই সমন্বয়কদের ডান হাত, বাম হাত হিসেবে নির্বিঘ্নে প্রটোকল দিয়ে গেছে। গুলশান-বনানী গ্যাং কালচারের অজস্র অভিযোগ অভ্যন্তরীণভাবে তাদের বিরুদ্ধে ছিল।
রিয়াদ নামের ছেলেটা গত ডিসেম্বর মাসে রূপায়ণ টাওয়ারে আমার সামনে অত্যন্ত উশৃঙ্খল আচরণ করেছিল। আমরা মেয়েরা তাকে থামানোর চেষ্টা করলে আমাদের ওপর পাল্টা চড়াও হয়। ওই ঘটনার পর ছেলেটার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে হুমকি, মারামারি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। আমি জেনে তখন মোটেও অবাক হইনি, কারণ ততদিনে বৈষম্যবিরোধীতে এই ধরনের মানুষজনের আনাগোনাই সর্বত্র টের পাওয়া যেত। ঠিকই তারা রূপায়ণ টাওয়ারে অবাধে আসা-যাওয়া করত। কারো দুর্নীতি বা অসততার ব্যাপারে অভিযোগ জানালে উত্তরে পিনড্রপ সাইলেন্স উপহার পেতে হবে।... অত্যন্ত দুঃখিত বন্ধুরা, বলতে হবে এই প্রথম কোনো চাঁদাবাজি করতে গিয়ে তারা পুলিশের হাতে ধরা খেল। ঠিকমতো খোঁজ নিলে বুঝবেন, এদের শেকড় অনেক গভীরে।
এদিকে চলমান পরিস্থিতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়া সারা দেশের সব কমিটি স্থগিত ঘোষণা করেছেন সংগঠনটির সভাপতি রশিদুল ইসলাম রিফাত। রোববার সন্ধ্যা ৬টায় রাজধানীর শাহবাগে চলমান বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ডাকা এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন তিনি।
এ ঘটনায় করা মামলায় আব্দুর রাজ্জাক রিয়াদসহ চারজনের ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। একই মামলায় গ্রেফতার এক শিশুকে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। রিমান্ডে নেওয়া অন্য আসামিরা হলেন- সাকাদাউন সিয়াম, সাদমান সাদাব ও মো. ইব্রাহিম হোসেন। গতকাল ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জিয়াদুর রহমান শুনানি শেষে তাদের এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এদিন বিকাল ৪টা ৫ মিনিটের দিকে তাদের একটি প্রাইভেটকারে করে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করা হয়।
আদালতে তোলার সময় তাদের দেখে আদালত প্রাঙ্গণে ‘চাঁদাবাজ’ ‘চাঁদাবাজ’ বলে স্লোগান দেন উপস্থিত লোকজন ও আইনজীবীরা। চাঁদাবাজ স্লোগান শুনে মাথা নিচু করে রাখেন গ্রেফতার এই ছাত্রনেতারা।
এর আগে গতকাল শাম্মী আহমেদের স্বামী সিদ্দিক আবু জাফর বাদী হয়ে গুলশান থানায় চাঁদাবাজির মামলা করেন। এতে তিনি ছয়জনকে আসামি করেন। রিয়াদ ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন- কাজী গৌরব অপু, সাকাদাউন সিয়াম, সাদমান সাদাব, মো. ইব্রাহিম হোসেন ও আইনের সংঘাতে জড়িত শিশু মো. আমিনুল ইসলাম।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ১৭ জুলাই সকাল ১০টায় আসামি আব্দুর রাজ্জাক রিয়াদ, কাজী গৌরব অপু গুলশানের ৮৩ নম্বর রোডে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক এমপি শাম্মি আহম্মেদের বাসায় যান। তখন তারা হুমকি ধমকি দিয়ে ৫০ লাখ টাকা ও স্বর্ণালংকার দাবি করেন। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যায়িত করে পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করানোর হুমকি দেন এবং টাকা চেয়ে চাপ দিতে থাকেন তারা। এক পর্যায়ে মামলার বাদী সিদ্দিক আবু জাফর বাধ্য হয়ে নিজের কাছে থাকা নগদ পাঁচ লাখ টাকা ও ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে আরো পাঁচ লাখ টাকা প্রদান করেন।
এ ঘটনার পর গত ১৯ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে আসামি রিয়াদ ও অপু বাদীর বাসায় প্রবেশ করে তার ফ্ল্যাটের দরজায় সজোরে ধাক্কা মারেন। বিষয়টি গুলশান থানা পুলিশকে মোবাইল ফোনে অবহিত করলে আসামিরা চলে যায়। পরে ২৬ জুলাই বিকাল সাড়ে ৫টায় আসামি রিয়াদের নেতৃত্বে অপরাপর আসামিরা বাদীর বাসার সামনে এসে তাকে খুঁজতে থাকেন। বাসার দারোয়ান মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তাকে বিষয়টি জানান। তখন আসামিদের দাবি করা বাকি ৪০ লাখ টাকা না দিলে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবেন বলে হুমকি দিতে থাকেন। পরে পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করলে তাৎক্ষণিক গুলশান থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পাঁচ আসামিকে হাতেনাতে আটক করে এবং ওই সময় এজাহারনামীয় আসামি কাজী গৌরব অপু দৌড়ে পালিয়ে যান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৩ জন ও গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ২ জন বহিষ্কার
এদিকে অভিযুক্ত তিন নেতাকে সংগঠন থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন৷ একই ঘটনায় অভিযুক্ত আরো দুজনকে স্থায়ী বহিষ্কার করেছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ। গত শনিবার রাতে পৃথক পৃথক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ও জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে এই পাঁচ নেতাকে বহিষ্কারের কথা জানিয়েছে সংগঠন দুইটি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বর্তমানে পুনর্গঠিত কাঠামোতে চলছে। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কদের একটি অংশের উদ্যোগে গত ফেব্রুয়ারিতে যাত্রা শুরু করেছে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি রিফাত রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক হাসান ইনাম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, সাংগঠনিক নীতিমালা ও শৃঙ্খলাপরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা মহানগর শাখার আহ্বায়ক ইব্রাহিম হোসেন মুন্না, সদস্য মো. সাকাদাউন সিয়াম ও সাদাবকে সাংগঠনিক পদ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এদিকে পৃথক দুটি জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনের দুই নেতাকে স্থায়ী বহিষ্কারের কথা জানান গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার ও সদস্যসচিব জাহিদ আহসান। তারা হলেন- সংগঠনটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক জানে আলম অপু ও সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান।
কুমিল্লায় বৈষম্যবিরোধী নেত্রীর পদত্যাগ
নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে পোস্ট দিয়ে পদত্যাগ করেছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক এবং কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র খাদিজা আক্তার কেয়া। গতকাল বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন খাদিজা আক্তার কেয়া। ফেসবুক পোস্টে সমন্বয়ক কেয়া লিখেন, ‘আমরা গণঅভ্যুত্থানের পর একটি প্ল্যাটফর্মে এসেছিলাম মুরাদনগর থেকে। সেই অভ্যুত্থানে আমাদের হাজারো ভাই-বোন শহিদ হয়েছেন। আমি তাদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করতে পারি না। তাই আমি নিজেই এসব কিছু থেকে সরে দাঁড়ালাম। এ প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকবে না।
তিনি আরো বলেন, গত ২৩ জুলাই কুমিল্লা টাউনহল মাঠে এনসিপির পদযাত্রায় পতিত আওয়ামী লীগের লোকজন সামনের সারিতে ছিল। যারা আমাদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বাধা দিয়েছিল। এ বিষয়গুলো আমাদের শহিদদের সঙ্গে বেইমানি করা হচ্ছে।
কেকে/ এমএস