রাজধানীর মোহাম্মদপুরে গত বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে ছিনতাইয়ের শিকার হন আহমাদ ওয়াদুদ নামের এক সাংবাদিক। তার ফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এ সময় ছিনতাইকারীরা তাকে কুপিয়ে আহত করে। মোহাম্মদপুর থানার কাছেই এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর প্রতিকার পেতে দ্রুতই মোহাম্মদপুর থানায় যান তিনি। কিন্তু সেখানে প্রতিকার পাওয়ার বদলে পুলিশের হাতে উল্টো হয়রানির শিকার হন ওয়াদদ।
এ ঘটনায় তিনি হতাশা ব্যক্ত করে ফেসবুকে পোস্ট দেন। এই স্ট্যাটাসটি দ্রুত ভাইরাল হয় এবং সমালোচানর ঝড় ওঠে। এরপরই নড়েচড়ে পুলিশ। ওয়াদুদের ফোনটি উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া দায়িত্বে অবহেলার কারণে চার পুলিশ সদস্যকে ক্লোজ (প্রত্যাহার) করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) এস এন নজরুল ইসলাম।
তবে পুলিশের এমন আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নাগরিকরা। তারা বলছেন, পুলিশের বিরুদ্ধে এনেিতই নানা অভিযোগ রয়েছে। ৫ আগস্টের পর প্রত্যাশা ছিল পুলিশ বাহিনীতে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। ফের নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন বাহিনীটির কিছু সদস্য। এখনও নাগরিক সেবার বদলে, মিলছে হয়রানি। যার জলন্ত দৃষ্টান্ত ওয়াদুদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি। নেটিজেনরা বলছেন, এ ঘটনা ভাইরাল না হলে হয়তো পরে পুলিশ সক্রিয় হতো না।
এদিকে শুক্রবার বিকেলে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) এক বার্তায় জানিয়েছে, মোহাম্মদপুরে ছিনতাইয়ের শিকার সাংবাদিকের মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করেছে পুলিশ। সেই সঙ্গে তিন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ডিএমপি আরও জানিয়েছে, দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ ওঠায় মোহাম্মদপুর থানার চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তারা হলেন উপপরিদর্শক (এসআই) জসিম উদ্দিন, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আনারুল এবং কনস্টেবল মাজেদুর রহমান ও কনস্টেবল মো. নুরুন্নবী।
এ ঘটনায় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বাংলাদেশ পুলিশের ফেসবুক পেজ থেকে দুঃখ প্রকাশ করে পোস্ট দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয় ‘জনাব আহমাদ ওয়াদুদের ফেসবুক স্ট্যাটাস ‘মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের সাথে এক ঘণ্টা’ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ভিকটিমের ফেসবুক স্ট্যাটাসে বর্ণিত অভিযোগ আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট ৪ জন পুলিশ সদস্যকে ইতোমধ্যে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে উপপুলিশ কমিশনার অফিসে সংযুক্ত করা হয়েছে। পুলিশ সদস্যের অসদাচরণের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছে। উল্লেখ্য, ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোনটি উদ্ধার হয়েছে এবং তিনজন আসামি গ্রেফতার করা হয়েছে।’
মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের সাথে এক ঘণ্টা : যা ঘটেছিল
ছিনতাইয়ের শিকার সাংবাদিক ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। ঘটনার বর্ণনায় ওয়াদুদ লিখেছেন, রাতে মোহাম্মদপুর থানার পাশ দিয়ে তিনি ও তার স্ত্রী যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনজন ছিনতাইকারী এসে মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। চাপাতির কোপে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত পান, তবে আঘাত গুরুতর নয়। ওয়াদুদ জানান, ঘটনার পাঁচ মিনিটের মাথায় তিনি মোহাম্মদপুর থানায় যান। কিন্তু থানায় গিয়েই অপ্রত্যাশিত আচরণ পান তিনি। ডিউটি অফিসার এসআই জসিম তাকে অপেক্ষা করতে বলেন। তিনি ছিনতাইয়ের অভিযোগের কথা বললে সাদা পোশাকের এক পুলিশ সদস্য তার দিকে আঙুল তুলে বলেন, ‘আপনার শার্টের বোতাম লাগান।’ ওয়াদুদ বলেন, ‘চাপাতির আঘাতে বোতাম খুলে গিয়েছিল। তিনি সরি বলে ঠিক করে নেন। এরপরও বলা হয় আরো বোতাম লাগাতে, যা সাধারণত কেউ লাগায় না।’
অভিযোগ লিখে জমা দিতে চাইলেও শুরু হয় টালবাহানা। বলা হয়, ‘লিখে দেওয়ার লোক নেই।’ কাগজ দেওয়া হলেও কলম দেওয়া হয়নি। নিজের কলম দিয়ে লিখে অভিযোগ জমা দিলেও কোনো কপি দেওয়া হয়নি। এরপর তিনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসানের কক্ষে যান। অভিযোগ জানালে ওসি বলেন, ‘আমি ওসি হয়েও কম দামি ফোন ব্যবহার করি। আপনি এত দামি ফোন নিয়ে ঘুরবেন, ছিনতাই তো হবেই!’ ওসির এমন মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম হয়। অনেকে মন্তব্য করেছেন, পুলিশের এমন মনোভাব ভীতিকর ও দায়িত্বজ্ঞানহীন।
ওয়াদুদ আরো জানান, পরবর্তীতে এএসআই আনারুল তাকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। সেখানে ছিনতাইকারীদের একজনকে চিনতেও পারেন তিনি। কিন্তু পুলিশ ঘটনাস্থলে না গিয়ে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে ফিরে আসে। পরে বলে, ‘এখন আর পাওয়া যাবে না। রাতে এসে অভিযান চালাব।’ পরে কোনো সুরাহা না করেই ফিরে যায় পুলিশ।
এদিকে গাইবান্ধার সাঘাটা থানায় মোবাইল ফোন হারানোর বিষয়ে অভিযোগ জানাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে এক এএসআইকে ছুরিকাঘাতে আহত করেন সাজু মিয়া (৩০) নামের এক যুবক। পরে পালাতে গিয়ে পুকুরে ডুবে তিনি মারা যান বলে জানিয়েছে পুলিশ।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার রাতে হারানো মোবাইল ফোনের বিষয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে থানায় যান সাজু মিয়া। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় পুলিশ তাকে পরে আসতে বলে। প্রথমবার ব্যর্থ হয়ে তিনি ফেরত যান। পরে আবার থানায় ফিরে আচমকা এক পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় এএসআই মহসিন আলী বাধা দিলে সাজু তার শরীরে লুকানো ছুরি বের করে মহসিনের মাথা ও হাতে আঘাত করেন।
এরপর পুলিশ ও স্থানীয়রা তাকে আটকানোর চেষ্টা করলে সাজু দৌড়ে সাঘাটা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের পুকুরে ঝাঁপ দেন। দীর্ঘ খোঁজাখুঁজির পর শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে রংপুর ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল ও স্থানীয় দমকল বাহিনীর সদস্যরা তার মরদেহ উদ্ধার করেন।
সাঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাদশা আলম বলেন, সাজু মিয়া কাগজপত্রের অভাবে হারানো মোবাইলের বিষয়ে জিডি করতে পারেননি। সে জানায়, তার কাছে বাড়ি ফেরার ভাড়াও নেই। তাকে ৫০ টাকা দিয়ে সিএনজি ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এক ঘণ্টা পর সে আবার থানায় ফিরে আসে এবং হামলা চালায়। ছেলেটি মানসিক ভারসাম্যহীনও হতে পারে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
কেকে/ এমএস