জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে তর্ক আছে, মতপার্থক্য আছে এবং বিরোধিতাও আছে। কেউ এই দলকে সমর্থন করেন, কেউ ঘৃণা করেন, কেউ আবার মনে করেন, এই দলের অতীত এতটাই কলঙ্কিত যে তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। এ নিয়ে বিতর্ক রাজনীতির অংশ। এসব তর্ক, মতবিরোধ ও অবস্থান রাজনীতিরই অংশ। কিন্তু সমস্যা তখন হয়, যখন আমরা রাজনৈতিক মতের বিরোধকে ব্যক্তিগত বিদ্বেষে পরিণত করি। প্রতিপক্ষকে মানুষ নয়, শত্রু মনে করতে শুরু করি। তখন আমরা ভুলে যাই ভিন্নমতের মানুষটিও একজন মানুষ।
সম্প্রতি জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় দুইবার অসুস্থ হয়ে পড়ে যান। তার সামনে-পেছনে অনেকেই ছিলেন। কিছু মানুষ উদ্বিগ্ন হন, কেউ কেউ প্রার্থনা করেন। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয় ভিন্ন দৃশ্যপট—ঠাট্টা, ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ আর অমানবিক কৌতুক। কেউ বলেন, ‘এটা নাটক’, কেউ বলেন, ‘ওরা এমনই করে’। একজন প্রবীণ রাজনৈতিক কথা বলতে গিয়ে মঞ্চে পড়ে গেছেন, এটা দেখে কেউ কেউ ভীষণ রকম মজা পেলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি এতটাই অমানবিক হয়ে গেছি? এতটাই বিকৃত আমাদের রাজনীতি ও সমাজবোধ?
প্রচণ্ড গরমে দীর্ঘসময় মঞ্চে বসে খাকলে একজন প্রবীণ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়তেই পারেন। এটা স্বাভাবিক। এতে হাসার কিছু নেই। এতে বিদ্রুপ করার কিছু নেই। আমাদের যা করা দরকার ছিল, তা হলো অন্তত নীরব সৌজন্য, ন্যূনতম মানবতা।
সমালোচনা করা, মতবিরোধ রাখা, কঠোর ভাষায় রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অঙ্গ। কিন্তু প্রতিপক্ষ অসুস্থ হয়ে গেলে অন্তত সম্মান দেখানো আমাদের মানবিক দায়িত্ব।
রাজনীতি যদি আমাদের নিষ্ঠুর করে তোলে, তবে সেটি আর রাজনীতি নয়, সেটি প্রতিহিংসার এক অন্ধ খেলা।
রাজনৈতিক মতাদর্শে দ্বিমত থাকবে। থাকবে বিরোধ। কেউ বাম, কেউ ডান, কেউ মাঝামাঝি। কেউ ধর্মনিরপেক্ষ, কেউ ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পক্ষে। কিন্তু কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে, তার জীবন সংকটে পড়লে, তখন আমাদের পরিচয় হওয়া উচিত একটাই—আমরা মানুষ। কেননা এই মানবতাই আমাদের সভ্যতা। এই মানবতাই আমাদের চূড়ান্ত পরিচয়।
একজন রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে গিয়ে মঞ্চে পড়ে গেলে যদি আমরা তালি দিই, হাসাহাসি করি, তাহলে ভাবতে হবে—এই সংস্কৃতি এক দিন ফিরে আসবে আমাদের দিকেই।
ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট নেতা হো চি মিন বলেছিলেন, অন্যান্য মানুষকে নিজের মতো করে ভালোবাসো।
আমরা চাই, রাজনীতি হোক যুক্তির। বিতর্ক হোক নীতিনির্ভর। মতবিরোধ থাকুক, কিন্তু মানবতাবিরোধী আচরণ না থাকুক। আপনি জামায়াতের বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে কথা বলুন। কিন্তু একজন প্রবীণ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে বলুন ‘আশা করি তিনি সুস্থ হবেন।’ এটাই মানবতা। কারণ, আপনি যদি সত্যিই নৈতিক অবস্থানে থাকেন, তবে আপনি জানেন—মানুষ হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো ক্ষমা, সহানুভূতি আর সম্মান। এগুলো হারিয়ে গেলে আর কিছু থাকে না।
আমাদের রাজনীতির বড় সমস্যা হলো, এখানে ভিন্নমত মানেই শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু একটি সুস্থ গণতন্ত্রে বিরোধী দল মানেই বিকল্প মত নয়, বিকল্প শত্রু নয়। সেখানে মতের সঙ্গে মানবতার সংঘাত নেই। তাই আসুন, আমরা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে অন্তত মানবিক রাখি। কোনো রাজনৈতিক আদর্শে আপনি একশবার দ্বিমত রাখুন। কিন্তু প্রতিপক্ষ অসুস্থ হলে তার প্রতি সহানুভূতি দেখান। এটাই সভ্যতা। এটাই আমাদের মানুষ হয়ে ওঠার প্রমাণ।
লেখক : কলামিস্ট ও সাংবাদিক