যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আগামী ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হতে পারে- এমন আশঙ্কায় দেশের তৈরি পোশাকসহ প্রধান রফতানি খাতগুলোতে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে মার্কিন ক্রেতারা কয়েকটি বড় অর্ডার স্থগিত করেছে, যা উদ্বেগ আরো বাড়িয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যে গড় শুল্ক ১৬ শতাংশ। নতুন শুল্ক কার্যকর হলে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৫১ শতাংশে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই উচ্চহারে শুল্ক আরোপ হলে রফতানি কার্যত অচল হয়ে পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে পোশাক খাতের পাশাপাশি চামড়া, পাটজাত ও হালকা প্রকৌশল পণ্য রফতানিও। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সূত্রে জানা গেছে- ওয়ালমার্ট, স্মার্টেক্সসহ একাধিক বড় ক্রেতা ইতোমধ্যে বড় অঙ্কের ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, অতিরিক্ত শুল্কের বোঝা তারা বহন করতে পারবেন না। এতে অনেক কারখানার উৎপাদন ২০-৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে, এমনকি শিল্পের একটি বড় অংশ অন্য দেশে স্থানান্তরিত হতে পারে।
এ প্রেক্ষাপটে সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক আলোচনা শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন জানিয়েছেন, তৃতীয় দফার আলোচনা সামনে এবং এর মাধ্যমে একটি ইতিবাচক ফলাফল আসবে বলে আশা করছেন তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিকল্প বাজার খুঁজে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হতে পারে। ফলে ব্যাংক খাত, রফতানি আয়, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক বিনিয়োগ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ইতোমধ্যেই স্থবির হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ছিল সম্ভাবনার উৎস, সেখানে নেতিবাচক ধারা শুরু হওয়ায় পরিস্থিতি আরো সংকটময় হয়ে উঠেছে। এখনই সময় দ্রুত ও কার্যকর কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্যোগ নেওয়ার। কারণ, এটি শুধু একটি খাতের সংকট নয়- বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অস্তিত্বের প্রশ্ন।
গতকাল সোমবার সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন বলেন, ‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ (পারস্পরিক বা পাল্টা শুল্ক) নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তৃতীয় পর্যায়ের আলোচনার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এ পর্যায়ের আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সময় চাওয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি, যুক্তরাষ্ট্র যৌক্তিক পর্যায়ে শুল্ক নির্ধারণ করবে। আশা করি, বাংলাদেশ তার সক্ষমতা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে।’
উপদেষ্টা বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের এ বিষয়ে নন-ডিসকলোজার এগ্রিমেন্ট (গোপনীয়তার চুক্তি) রয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র কী চেয়েছে, বা কী আলোচনা হয়েছে তার বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়।’
শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, আমরা রোববার যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরেছি আমাদের দ্বিতীয় রাউন্ডের আলোচনা শেষ করে। আলোচনার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা আলোচনা শেষ করে আবার প্রস্তুতি নিচ্ছি তৃতীয় রাউন্ডের আলোচনার জন্য। এরপর আমরা যুক্তরাষ্ট্রে যাব। আমরা আশা করছি একটা ভালো আউটকাম আসবে।’ তিনি বলেন, আমাদের আলোচনাগুলো উৎসাহব্যঞ্জক। আলোচনাটা যথেষ্ট এনগেজিং ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও আমার বৈঠক হয়েছে। দফাওয়ারি আমাদের সঙ্গে যারা নেগোশিয়েশনে যুক্ত ছিলেন তাদের ৩৫-৪০ জনের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘পাল্টা শুল্ক বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের অভিঘাত। সেজন্য সরকার সর্বাত্মক পর্যায়ে জড়িত থেকে কাজ করছে। ইতোমধ্যে কিছু কাজ করা হয়েছে, আরো কিছু কাজ করতে হবে। এখন আমরা অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করলাম। তাদের মতামত নিলাম। আমাদের প্রস্তুতি আছে। সামনে যে কোনো বিষয়ে আসলে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সেটি নিয়ে আমরা আলোচনা করব।’
ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বিকেএমইএর সভাপতি মো. হাতেম বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ট্যারিফ আলোচনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যের যে আলোচনা হয়েছে সেটি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের যা অবহিত করা হয়েছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে প্রথমে একটি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি চাচ্ছে, যেখানে তাদের নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। এ বিষয়ে গত কয়েক দিনে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে যে আলোচনা হয়েছে, তাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এরপর ট্যারিফ (শুল্ক) ও নন-ট্যারিফ (অশুল্ক) বিষয়ে আলোচনা হবে।
ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘আমেরিকার কিছু কৌশলগত বিষয়ে রয়েছে। তার মধ্যে নিরাপত্তা ও অন্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত। এখন ট্যারিফ অফার নিয়ে আলোচনা করবে। নন-ট্যারিফ বাধা কী কী আছে, সেগুলো দূর করার জন্য কী করণীয়, সেসব বিষয়ে আলোচনা হবে। আশা করা হচ্ছে ১ আগস্টের আগেই আলোচনা শেষ হবে। বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করার বিষয়ে সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে।’
বিজিএমইএ’র সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের প্রেক্ষাপটে সংগঠন হিসেবে তারা আলোচনায় সম্পৃক্ত হয়েছি। আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, কী কারণে আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা বিস্তারিতভাবে তা জানিয়েছি। যদি ৩৫ শতাংশ শুল্কই বহাল থাকে, তাহলে সেটা তৈরি পোশাক খাতের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হবে।’
তিনি বলেন, ক্ষতির মাত্রা নির্ভর করবে প্রতিযোগী দেশগুলো- যেমন ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তানের ওপর আরোপিত শুল্ক কেমন হয় তার ওপর। যদি সবার ওপর একই ধরনের শুল্ক পড়ে, তাহলে অন্তত একটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ থাকবে। তখন প্রতিযোগিতা হবে তুলনামূলক ভারসাম্যপূর্ণ।’
মাহমুদ হাসান খান বলেন, শুধু বাংলাদেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হলে সেটা হবে স্পষ্ট বৈষম্যমূলক এবং তা প্রতিযোগিতায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে আমাদের শিল্পকে। তাই সরকারের পাশাপাশি কূটনৈতিক পর্যায়েও সমতা নিশ্চিত করার জোর দাবি জানিয়েছি।
বিটিএমএ জানিয়েছে, কোভিড-১৯ পরবর্তী বৈশ্বিক মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি সংকট, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, ডলার সংকট, টাকার অবমূল্যায়ন, ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি, প্রণোদনার পরিমাণ কমে যাওয়া ইত্যাদি নানা সংকট একত্রে কাজ করছে। এর ফলে স্পিনিং সেক্টরসহ টেক্সটাইল মিলগুলো চরম বিপদে পড়েছে। এছাড়া, বিদেশি সুতা আমদানিতে শুল্ক না থাকায় স্থানীয় মিলগুলো আরো বেশি চাপে পড়ছে।
বর্তমানে শিল্পকারখানায় তীব্র জ্বালানি সংকট, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক নানা সংকটজনিত কারণে উৎপাদন খরচ ক্ষেত্রবিশেষে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে, যা অর্থ উপদেষ্টা সরেজমিন যাচাই করেছেন। এর ফলে স্পিনিং সেক্টর ভয়াবহ সংকটে রয়েছে। দেশীয় টেক্সটাইল শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পর্যাপ্ত ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সরবরাহ, ব্যবসাবান্ধব নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ, জ্বালানি খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, ঋণ ঝুঁকিতে থাকা উদ্যোক্তাদের জন্য এক্সিট প্ল্যান, নতুন শিল্প খাতে বিনিয়োগে সহায়তা ও নীতি সহায়তা, রাজস্ব বাড়াতে নতুন করদাতার খোঁজ- এসব পদক্ষেপ জরুরি।
বিজিএমইএ ও বিটিএমএ সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের প্রেক্ষাপটে ইতোমধ্যেই কয়েকটি বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান তাদের ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে। ওয়ালমার্ট, স্মার্টেক্সসহ একাধিক কোম্পানি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা বাংলাদেশের পোশাক রফতানিতে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হওয়া তৈরি পোশাকের একটি বড় অংশই যায় ওয়ালমার্টের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি প্যাট্রিয়ট ইকো অ্যাপারেল লিমিটেডকে ১০ লাখ সাঁতারের প্যান্টের অর্ডার দিয়েছিল, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। তবে গত বৃহস্পতিবার ক্ল্যাসিক ফ্যাশনের মাধ্যমে ওয়ালমার্ট সেই অর্ডার স্থগিতের বার্তা পাঠায়।
প্যাট্রিয়ট ইকো অ্যাপারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হোসেন বলেন, ‘ক্রয়াদেশ স্থগিত হয়েছে, বাতিল হয়নি- তবু উদ্বেগ থেকেই যায়। কারণ অতিরিক্ত শুল্কের বোঝা নিয়ে পণ্য উৎপাদন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।’
এটিএস অ্যাপারেল লিমিটেডও যুক্তরাষ্ট্রে বড় পরিসরে পোশাক রফতানি করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম জানান, ‘বর্ধিত শুল্ক কার্যকর হলে পোশাক খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। তবে প্রতিযোগী দেশগুলোর জন্য শুল্কের হার কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে, তা সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।’
বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান স্মার্টেক্স সম্প্রতি মাদার কালার লিমিটেডের ৭ লাখ ডলারের একটি রফতানি আদেশ স্থগিত করেছে। গত বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটি ই-মেইলের মাধ্যমে আদেশ স্থগিতের সিদ্ধান্ত জানায়। এ ছাড়া চট্টগ্রামভিত্তিক ফোর এইচ নামের একটি পোশাক কারখানার কিছু অর্ডারও যুক্তরাষ্ট্রের বায়াররা স্থগিত করেছেন বলে জানা গেছে।
কেকে/এআর