ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত ১১ মাসেও প্রকাশ্যে আসতে পারেনি আওয়ামী লীগ। বারবার ফিরে আসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে দলটি। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে বসে নেই বিদেশে পালিয়ে যাওয়া এবং দেশে গা ঢাকা দেওয়া দলটির নেতাকর্মীরা। পলাতক নেতাকর্মীদের অনেকেই বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ডসহ সারা দেশে সংঘঠিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে ইস্যু করে তারা নানা তৎপরতা চালাচ্ছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের দুর্ভাগ্যের মাস আগস্টকে সামনে রেখে নতুন করে পরিকল্পনা সাজিয়েছে তারা। সাম্প্রতিক সময়ের অপ্রীতিকর ঘটনাগুলোকে পুঁজি করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারাও করছে বলে বিশেষ সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে ফ্যাসিবাদ পুনরায় মাথা চাড়া দিতে পারে।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, পুরান ঢাকার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভিডিওটি কেবল সহিংসতার প্রমাণ নয়, বরং এটি একটি বার্তা যা হয়তো ভয় ছড়াতে, কিংবা জনমত প্রভাবিত করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
ঠিক এক বছর আগে ঘটে যাওয়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিপরীতে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও আইনের শাসনের পতনের এমন আভাস দেশের জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করছেন তারা। দেশ যখন একটি সুষ্ঠু রাজনীতির ধারা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে হাঁটছিল, বহু বছর পর জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখছিল, ঠিক সে সময় এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এবং এর মাধ্যমে রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির পুরোনো সংস্কারের চর্চাতে ফ্যাসিস্টের ফিরে আসার পথ সুগম করতে কোনো ষড়যন্ত্র চলছে কি না এমন প্রশ্নও ছুড়ছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।
একই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। গত শনিবার গুলশানে হোটেল লেকশোরে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের এক অনুষ্ঠানে তিনি সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘দেশে ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি, ষড়যন্ত্র আবারো শুরু হয়েছে, জোরেশোরে শুরু হয়েছে। সবার কাছে আহ্বান থাকবে আবারও আপনাদের সোচ্চার এবং সচেতন হতে হবে। কারা কীভাবে ষড়যন্ত্র করছে, কারা কীভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা বলছে এবং ক্ষণে ক্ষণে অবস্থান পরিবর্তন করছে, এসব বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। আমাদের সবাইকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। আমাদের যে যুদ্ধ ছিল গণতান্ত্রিক অধিকার, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার, সেই যুদ্ধ কিন্তু এখনো শেষ হয়ে যায়নি।’
এই দেশ সবার উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘কারা কী করছে, কারা কী ভূমিকা রাখছে, কারা কী বর্তমানে বলছে? বলার মধ্যে পার্থক্য কী? তাদের অবস্থান ঘনঘন পরিবর্তন করছে, এসব বিষয়ে আপনারা নজরে রাখবেন। প্রশাসনের মধ্যে এখনো বিগত স্বৈরাচারের ভূত লুকিয়ে আছে। কাজেই সেই ভূত এবং বর্তমানের নতুন কোনো ভূত যদি থাকে, তারা কী ষড়যন্ত্র করছে, সেই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সবাই সচেতন থাকতে হবে। যদি আমরা সচেতন না হই, এ দেশকে টিকিয়ে রাখা মুশকিল হবে।’
সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ককটেল বিস্ফোরণ, সড়কে ছিনতাই এবং ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এর পেছনে আওয়ামী লীগের যোগসূত্রতা রয়েছে বলে বেশ কয়েকটি সূত্র থেকে জানা গেছে। এর মাধ্যমে মূলত তারা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। তবে অতীতের মতো এবারো আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব ঘটনায় জড়িতদের আটক করা অব্যাহত রয়েছে বলে পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে গত কয়েক দিনে ডেমরা, উত্তরা, মোহাম্মদপুর ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে। এসব ছিনতাইয়ে আওয়ামী লীগের লোকজন জড়িত বলে অভিযোগ করছেন কেউ কেউ।
সম্প্রতি এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, দেশকে অস্থিতিশীল করতে আওয়ামী লীগের একাধিক টিম মাঠে সক্রিয়। কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় আওয়ামী লীগের লোকজন এখন প্রকাশ্যে কিছু করতে পারছেন না। ফলে বেকায়দায় আছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তারা দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারেন।
তথ্য অনুযায়ী, নানা সংগঠন ও আন্দোলনের নামে আওয়ামী লীগ তৎপরত হওয়ার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি বিভাগে কর্মরত তাদের নেতাকর্মীদের কাজে লাগানো হচ্ছে। এ ছাড়া বিদেশে বসে জুম, হোয়াটসআপ ও সামাজিক মাধ্যমে মিটিং করে নানা পরিকল্পনা করছেন আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনাসহ পলাতক নেতারা। তাদের প্রধান টার্গেট ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে ব্যর্থ করা। চলতি বছরের ‘আগস্ট’ মাসকে সামনে রেখে বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ সময় দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করবে দলটি।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ধানমন্ডি ৩২ ও ২৭, জিগাতলা, খেজুরবাগান, শুক্রাবাদ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বসিলা, ঢাকা উদ্যান, পল্লবী মেট্রোরেলের ফাঁকা জায়গা, বনানী ও বিমানবন্দর এলাকায় ঝটিকা মিছিলের পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের।
পুলিশ প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ এক বিশাল ষড়ষন্ত্রের অংশ। মূলত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের যে বিচার শুরু হয়েছে সেটিকে তারা বাধাগ্রস্ত করতে চায়।
ডিএমপির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাদের কিছু নেতাকর্মী ধরা পড়লেও বাকিরা তো এখনো বাইরে। ফলে তাদের নেতাকর্মীরা তো চাইবে দেশকে অস্থিতিশীল করতে। তবে প্রশাসনও তাদের নানা পরিকল্পনার বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করছে।’
এ ছাড়া নানাভাবে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত দল আওয়ামী লীগ। পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর তার দল আওয়ামী লীগ মাঠের রাজনীতিতে একেবারে নীরব হয়ে গেলেও সরব হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজের পাশাপাশি টেলিগ্রাম চ্যানেল, এক্স (সাবেক টুইটার), ইউটিউবে প্রতিনিয়ত তথ্যমূলক ভিডিও আপলোড করা হচ্ছে। পাশাপাশি ভিনদেশীয় একটি নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে সেখান থেকেও আপডেট জানানো হচ্ছে।
সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়, নেতাকর্মীদের বাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ সময় আওয়ামী সমর্থিত কয়েকজন ‘গণপিটুনিতে’ হত্যার শিকারও হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মাঠের রাজনীতি থেকে ‘উধাও‘ হয়ে গেলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সক্রিয় রয়েছে আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগের ওই অফিসিয়াল মাধ্যমের বাইরে আওয়ামী লীগের প্যাডে বা অন্য কোনো মাধ্যমে বক্তব্য-বিবৃতি এলে তাতে বিভ্রান্ত না হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ভেরিফায়েড ফেসবুকসহ আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গত কয়েকদিনের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিনিয়তই এসব মাধ্যমে পোস্ট, ফটোকার্ড, ভিডিও, বার্তা আপলোড দেওয়া হচ্ছে। এতে দলের নেতাকর্মী ও গণমাধ্যমকে উদ্দেশ করে নানা নির্দেশনা ও বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা, অগ্নিকাণ্ড, ভাঙচুরের আপডেট দেওয়া হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতিবাচক এবং আওয়ামী লীগের ইতিবাচক নানা খবরও শেয়ার করা হচ্ছে।
এ ছাড়া নিজস্ব ব্যবস্থাপনা কিংবা অন্য সোর্সে পাওয়া নানা ভিডিওচিত্র আপলোড করা হচ্ছে। সম্প্রতি ফেসবুক পেজ থেকে দলের নেতাকর্মীদের হয়রানি, বাড়িঘর ভাঙচুরের বিষয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের বা জিডি করা এবং সেনাক্যাম্পে গিয়ে অভিযোগ দায়েরের পরামর্শ দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনো ‘অপপ্রচার’ হলে বা দলের নামে বা প্যাডে কোনো বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার হলেও সেটারও ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে এসব মাধ্যম থেকে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেও হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে দেশে-বিদেশে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ফোন করে নানা পরামর্শ ও নির্দেশনা দিচ্ছেন।
অবশ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একাধিক কথোপকথন ফাঁস হওয়ার প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা সতর্কতার সঙ্গে কথা বলছেন; এমন একাধিক নেতা করেছেন। তারা বলেছেন, শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশে অবস্থানকারী নেতাকর্মীদের সঙ্গে খুব কমই কথা বলছেন। বিদেশে দলের যেসব নেতাকর্মী রয়েছেন তাদের সঙ্গে কম-বেশি যোগাযোগ করে নানা নির্দেশনা দিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে প্রকাশ্যে একেবারেও নীরব হলেও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথে রয়েছে; এমন ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে নানাভাবে সমর্থন দিচ্ছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন। এসব থেকে তাদের নানা ধরনের পরামর্শ ছাড়াও দলের মুখ না চেনা কর্মীদের এসব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে উৎসাহ দিচ্ছে। এ ছাড়া দলীয় প্রধানের নির্দেশনা অনুসরণ করে তারা বিদেশে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছেন।
কেকে/ এমএস