আলোচনার মাধ্যমে দর-কষাকষির সুযোগ রেখেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১ আগস্ট ২০২৫ থেকে বাংলাদেশের সব রফতানি পণ্যের ওপর আরো ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো কার্যকর বাণিজ্য চুক্তি না হলে এই শুল্ক কার্যকর হবে।
এই ঘোষণার পরপরই অর্থনীতি ও শিল্প খাতজুড়ে চরম উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন একটি উচ্চ শুল্কহার বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পসহ দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা আয়, শিল্পায়ন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।
অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করছেন, দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের মতে, আলোচনায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি এবং কাঠামোগত দুর্বলতা ট্রাম্প প্রশাসনকে চাপ প্রয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে। এদিকে, দেশের ব্যবসায়ীরা এই সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি চরম নেতিবাচক বার্তা হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর রফতানিকারকরা সরাসরি ক্ষতির মুখে পড়বেন। বিশেষ করে যারা তৈরি পোশাক, হস্তশিল্প বা চামড়াজাত পণ্যের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাদের জন্য এই শুল্ক আরোপ গভীর সংকট তৈরি করবে। এমতাবস্থায় সময়োপযোগী কূটনৈতিক তৎপরতা, কার্যকর বাণিজ্য কৌশল এবং বহুমুখীকরণ উদ্যোগ গ্রহণ এখন অতীব জরুরি বলে মনে করছেন তারা।
মার্কিন শুল্ক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশের রফতানিপণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে আগে গড়ে ১৬ শতাংশ শুল্ক প্রযোজ্য ছিল। এখন নতুন করে আরো ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা মিলিয়ে মোট শুল্ক দাঁড়াচ্ছে ৫১ শতাংশ। এখন যদি কোনো পণ্যের উৎপাদন খরচ হয় ১০০ ডলার, তবে সেই পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় আমদানিকারককে শুল্ক বাবদ ৫১ ডলার পরিশোধ করতে হবে। ফলে পণ্যের ল্যান্ডেড কস্ট বা যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর মোট খরচ দাঁড়াবে ১০০ + ৫১ = ১৫১ ডলার। এই ৫১ ডলার অতিরিক্ত খরচ হলো শুধু শুল্কজনিত, যা আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এই অতিরিক্ত খরচ তিনভাবে প্রভাব ফেলতে পারে আমদানিকারক নিজে বহন করতে পারে, ফলে তাদের মুনাফা কমবে।
রফতানিকারকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হতে পারে, ফলে এফওবি (রফতানিকারকের গুদাম থেকে জাহাজে তোলা পর্যন্ত যেসব খরচ) মূল্য কমে যেতে পারে। উভয় পক্ষ খরচ ভাগাভাগি করতে পারে, যার ফলে দু’পক্ষের ওপরেই কিছুটা চাপ পড়বে। এই মূল্যবৃদ্ধি খুচরা বাজারে পণ্যের দাম বাড়বে এবং বাংলাদেশের পণ্যসমূহ তাদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান হারাতে পারে। এর ফলে রফতানি আদেশ কমে যাওয়ায় শঙ্কা তৈরি হবে।
বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বড় রফতানি বাজার হওয়ার এ শুল্ক দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও শিল্প খাতে বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও হস্তশিল্পের মতো খাতাগুলো বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুল্ক আরোপের সরাসরি প্রভাব পড়বে রফতানি আদেশে ক্রয়াদেশ কমে যাবে এবং তা কারখানার উৎপাদন কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করবে। রফতানি কমলে এসব খাতে শ্রমিকের অনেকেই চাকরি হারাতে পারেন, ফলে কর্মসংস্থান সংকট দেখা দেবে এবং দারিদ্র্য পরিস্থিতি আরো জটিল হবে। রফতানি আয় কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ হ্রাস পাবে, যা টাকার মান ও বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও ক্রেতারা চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ার মতো বিকল্প সরবরাহকারীর দিকে ঝুঁকে পড়তে পারেন। এতে বাংলাদেশের বৈশ্বিক বাজার হারানোর ঝুঁকি বাড়বে এবং দীর্ঘমেয়াদে শিল্প খাতের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে পারে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘চূড়ান্ত শুল্কহার নির্ধারিত হবে ইউএসটিআরের (যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি) সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে। এ কারণেই আমাদের তাদের (ইউএসটিআর) সঙ্গে বৈঠক রয়েছে। এখনো শুল্কহার চূড়ান্ত হয়নি।’ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা থেকে ইতিবাচক ফল আসবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি আরো বলেন, ফলাফল যাই হোক, সরকার তা বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। এ পর্যন্ত আমাদের যেসব বৈঠক হয়েছে, সবই ইতিবাচক।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. এমএ রাজ্জাক বলেন, বাড়তি এই শুল্ক দেশের রফতানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। যার প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। ফলে শুল্কের এই বিষয়টিকে সতর্কতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে ডিল করতে হবে। এটা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে এবং সেখানে আমাদের দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর বলেন, আমরা উইন উইন সলুসনের কথা যেটা চিন্তাভাবনা করছিলাম। যে উভয় পক্ষ লাভবান হব এমন একটা শুল্কের ফর্মুলা আমরা বের করব। সেই সূত্র এখনো পর্যন্ত বের করতে পারেনি, এটা একটা সমস্যা। যে আলাপ-আলোচনাগুলো হয়েছে ইউএসটিআরএর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সেটিও কোনো ভালো ফলাফল বা সুনির্দিষ্ট কোনো ফলাফল অর্জন করতে পারেনি। তবে হাতে সময় আছে যেহেতু শুল্ক কার্যকর হবে ১ আগস্ট থেকে সুতরাং এ সময়ের মধ্যে আমরা একটা কার্যকর শুল্ক চুক্তিতে উপনীত হতে পারে, তবে সেটা নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ কি কৌশল নির্ধারণ করবে তার ওপর।
বিজিএমইএ’র সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের একক বড় বাজার। সে জন্য আমরা শুরু থেকে সরকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষির অনুরোধ জানিয়েছি। এ জন্য আমরা আমাদের তরফ থেকে সর্বোচ্চ সহায়তা দেওয়ার জন্যও প্রস্তুত ছিলাম। তবে পাল্টা শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষি নিয়ে ব্যবসায়ীদের অন্ধকারে রাখা হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে আমাদের শুধু আশ্বাস দিয়ে বলা হয়েছে, ‘সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত রেখে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, আমরা ব্যবসায়ীমহল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করছি। কারণ, এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষির জন্য তিন সপ্তাহ সময় আছে। আমরা চাই, দর-কষাকষির প্রক্রিয়ায় একটি লবিস্ট নিয়োগ করা হোক। পাশাপাশি এ প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদেরও যুক্ত করা হোক। আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়গুলো আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলতে চাই।
বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফজলুল হক মনে করেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক আসলে এটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়, বরং ১ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরির একটি কৌশল। তিনি অভিযোগ করেন, শুল্ক আলোচনা প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে, যা খুবই দুঃখজনক। প্রতিনিধিদলে কোনো ব্যবসায়ী বা খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ না থাকায় দর-কষাকষি দুর্বল হয়েছে। ভিয়েতনাম ইতোমধ্যে ২০ শতাংশ শুল্ক সুবিধা পেয়েছে, ফলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। ফলে সরকারকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে হবে, এই শুল্ক অপরিবর্তিত থাকলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসবে।
বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ব্র্যান্ড বিজিএমইএ-এর প্রাক্তন পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যাবে, যা আমাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস করবে। আমরা যখন আন্তর্জাতিক বাজারে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে, তখন এই ধরনের উচ্চ শুল্ক আমাদের রপ্তানি আয় কমিয়ে দেবে এবং দেশের লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানকে হুমকির মুখে ফেলবে।’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, এই শুল্কহার যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার ব্যাপক বাণিজ্যঘাটতি দূর করার জন্য যথেষ্ট নয়; বরং তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। যদি কোনো বাংলাদেশি কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা স্থাপন করে উৎপাদন শুরু করে, তাহলে সেই পণ্যের ওপর কোনো শুল্ক থাকবে না। বরং তারা সব অনুমোদন দ্রুততম সময়ে, পেশাদার ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পাবে এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।
চিঠিগুলোতে ট্রাম্প সতর্ক করেন, কোনো দেশ পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে তাদের আমদানি শুল্ক বাড়ালে, তার প্রশাসন আরও বেশি হারে শুল্ক আরোপ করবে।
প্রসঙ্গত, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মঙ্গলবার ভোরে (বাংলাদেশ সময়) তার ট্রুথ সোশ্যাল অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা এক চিঠিতে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন যা তিন মাস আগে প্রস্তাবিত ৩৭ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ কম।
কেকে/ এমএস