সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সমঝোতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। গতকাল বুধবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, সংলাপে বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে। এর জন্য তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ছাড়ের মানসিকতার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি বক্তব্যে সমঝোতার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। তিনি গত বুধবার একটি অনুষ্ঠানে দলীয় নেতাকর্মীদের স্যাক্রিফাইসের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ভিন্নমতকে সহনশীলতা ও সম্মান দেখিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানই হবে দলের পথ। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদও জানিয়েছেন, ঐকমত্য কমিশনের বেশিরভাগ বিষয়েই বিএনপি একমত। এরপরই ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে আলোচনায় অগ্রগতির কথা জানানো হয়।
গত বুধবার পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তারেক রহমান বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। দল বড় হলে দায়িত্ব অনেক, স্যাক্রিফাইসটাও বেশি। তিনি বলেন, গণতন্ত্র যখনই হুমকির মুখে পড়েছে, তখনই বিএনপি রাজপথে নেমেছে, এ ঐতিহ্যকে সামনে রেখেই দলকে আরো সুসংগঠিত করা হচ্ছে।’ তারেক রহমান বলেন, ‘বিএনপির সব ক্ষমতার উৎস জনগণ। দল হিসেবে আমাদের নীতি ও আদর্শ নিয়ে জনগণের কাছে যেতে হবে। আমাদের নেতাকর্মীদের বলছি, জনগণের সঙ্গে থাকুন, জনগণকেই পাশে রাখুন।’ তিনি আরো বলেন, ‘দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি যদি শক্ত করতে হয়, তবে বিএনপিকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। ভিন্নমতকে সহনশীলতা ও সম্মান দেখিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানোই হবে দলের পথ।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘রাজনৈতিক সংস্কারের প্রস্তাব বিএনপি আগেই দিয়েছে। তারপরও অন্তর্বর্তী সরকারের ঐকমত্য কমিশনেও অনেক ছাড় দিয়েছে বিএনপি। অনেক বিষয়ে একমত না হলেও গণতন্ত্রের স্বার্থে ছাড় দিয়েছে বিএনপি। যেন সবাই নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায়।’
আলী রীয়াজ জানিয়েছে, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন সম্পর্কিত বিধান ও বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের নবম দিনের আলোচনা শেষে ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা জানান। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আজকের আলোচনায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন সম্পর্কিত বিধান ও বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিগত সময়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানের ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেছে।
কমিশনের সহসভাপতি বলেন, সংবিধানের ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধন বিষয়ে যে ঐকমত্য হয়েছে তা হলো- ‘কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত যে কোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত মানদণ্ড, নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণক্রমে উক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করা হইবে’। আলী রীয়াজ আশা প্রকাশ করে বলেন, সংবিধানের ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধন বিষয়ে ঐকমত্য কমিশন থেকে দেওয়া প্রস্তাবের আলোকে যে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি হয়েছে তা ভবিষ্যতে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। এতদিন ধরে এই ক্ষমতার যে অপব্যবহার হয়েছে তা বন্ধ হবে। বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ে অগ্রগতির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, রাজধানীতে সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী আসন থাকবে। তবে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে প্রধান বিচারপতি সময়ে সময়ে যে সার্কিট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন তার পরিবর্তে রাজধানীতে সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী আসন থাকবে এবং প্রধান বিচারপতি কর্তৃক প্রতিটি বিভাগে এক বা একাধিক স্থায়ী বেঞ্চ থাকবে। অর্থাৎ হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে। এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে সংবিধানের ১০০ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিবর্তন হবে।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, জতীয় সনদ দ্রুত বাস্তবায়ন হোক বিএনপি তা চায়। আর যেন এটি দীর্ঘায়িত না হয়। তিনি বলেন, ‘বিগত সময়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ক্ষমতার যথেষ্ট অপব্যবহার হয়েছে। উপর্যুপরি ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞে উৎসাহ দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের সময় রাষ্ট্রপতি এককভাবে এবং সংসদীয় সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে ফাঁসির আসামিকেও ক্ষমা করা হয়েছে। এ জন্য এ বিষয়ে নীতিমালা জরুরি। এ বিষয়ে সংসদের আলোচনা হওয়া জরুরি।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘বিএনপি নীতিগতভাবে একমত, ক্ষমা প্রদর্শন আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। সংবিধানে যা অন্তর্ভুক্ত হবে। আর হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ বিভাগীয় পর্যায়ে স্থাপনের বিষয়েও আমরা একমত। তবে এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করেই এটি করতে হবে। তা করা গেলে জনগণের দোরগোড়ায় ন্যায়বিচার পৌঁছবে।’ জনগণের কাছে আমাদের দায় অনেকটাই বেশি উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘এখানে মতামত দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা করা হচ্ছে।’
এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, ‘বিগত দিনে চিহ্নিত অপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। তাই এ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে। কোনো অপরাধীর ক্ষমার বিষয়ে রাষ্ট্রপতি নিজে নিজে ক্ষমা করতে পারবেন না। অপরাধীর ক্ষমা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করতে একটি কমিটি থাকবে। এ ক্ষেত্রে পরিবার বা ভুক্তভোগীর রক্তের সম্পর্ক থাকা ব্যক্তির মতামত লাগবে। তারা চাইলে সমঝোতা করতে পারবেন।’
বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থানান্তরের বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী একমত পোষণ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অনেক পরিবারের বিচার পেতে অনেক দূর থেকে ঢাকায় আসতে হয়। এক্ষেত্রে অনেকের থাকা খাওয়া ও যাতায়াতের ব্যয়ভার বহন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই আমরা এ বিষয়টির পক্ষে বলেছি। শুরুতে হয়তো কিছুটা সীমাবদ্ধতা দেখা দিতে পারে। এত বিচারপতি কোথা থেকে আসবে। তারা ঢাকা থেকে যেতে রাজি হবেন কিনা বা আইনজীবী পাওয়া যাবে কিনা। হয়তো কিছুটা বেগ পোহাতে হবে। তবে সরকার চাইলে বাজেট বাড়াতে পারে ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে পারে। তাহলে অনেক বিচারপতিই ঢাকার বাইরে যেতে আপত্তি করবেন না।’
কেকে/ এমএস