বন্দরে বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া এবং রাখাইন করিডরের বিরুদ্ধে আজ শুরু হচ্ছে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে দুদিনের রোডমার্চ। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দেশপ্রেমিক জনগণের ব্যানারে আজ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে রওনা দেবে। রোডমার্চ সফল করতে গত দুদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করেছে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাম জোটের সংগঠনগুলো এবং বাংলাদেশ জাসদ ব্যস্ত সময় পার করেছেন।
আওয়ামী আমলের প্রকল্প অন্তর্বর্তী সরকারের চিন্তা: আওয়ামী লীগ শাসন আমলের শেষ দিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডের একটি চুক্তির চেষ্টা করা হয়। সেসময় গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে সেটা আর করা হয়নি। তবে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রকল্পটি নতুন করে হালে পানি পায়। এখন ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে চুক্তির খুব চেষ্টা করা হচ্ছে। বাম জোটের নেতৃত্বে এই চুক্তির বিরোধিতা করে একাধিক কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। শেষে বাম জোট ও অন্যান্য প্রগতিশীল শক্তির সমন্বয়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দেশপ্রেমিক জনগণের ব্যানারে এই রোডমার্চের ঘোষণা দেওয়া হয়।
রাখাইন করিডর বাংলাদেশে যুদ্ধ-জটিলতা তৈরি করবে:
নানা মত ও পথের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় শক্তির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সংঘাত খুবই উত্তপ্ত হয়ে আছে। একদিকে আরাকান আর্মি রাখাইনের বেশিরভাগ এলাকা তাদের দখলে নিয়েছে। আবার অং সাং সুচির নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গেও তাদের টানাপোড়েন আছে। এখন মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতায় দেশটির সেনাবিহানী। অন্যদিকে সেনাবাহিনী ও রাখাইনদের গণহত্যা ও নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে ১৩ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এই রোহিঙ্গাদের আবার একাধিক সংগঠন রয়েছে। আরসা ও আরসাবিরোধী দুটি গোষ্ঠী রোহিঙ্গা যুবকদের নিয়ে সশস্ত্র সংগঠন গড়ে উঠেছে। আবার এই সংগঠনগুলো সম্প্রতি ঐক্য করেছে বলেও শোনা যাচ্ছে। এই সময় করিডর দিলে বাংলাদেশ বহুমাতৃক বিপদে পড়তে পারে। আরাকান আর্মির নিশানা হতে পারে বাংলাদেশ, সেনানিয়ন্ত্রিত মিয়ানমার সরকারের রোষাণলে পড়ারও শঙ্কা আছে, আবার রোহিঙ্গা উগ্রবাদিরাও ওই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে পারে। এই করিডর দিলে একটা যুদ্ধ-জটিলতা তৈরি হওয়ার সমূহ শঙ্কা রয়েছে।
কর্মসূচি সফলে তৎপর বাম দলগুলো:
চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি কোম্পানিকে লিজ দেওয়া ও রাখাইনে করিডর দেওয়ার তৎপরতা বাতিলের ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডমার্চ ঘিরে ইতোমধ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বাম দলগুলো। সভা, সেমিনার, মতবিনিময় সভা ও প্রচারপত্র বিতরণসহ প্রস্তুতির কোনো কমতি নেই। রোডমার্চ ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লার বিভিন্ন পয়েন্টে পথসভা ও মিছিল শেষে কুমিল্লায় প্রথম দিনের সমাপনী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ফেনীতে রাত্রিযাপন শেষে দ্বিতীয় দিন ২৮ জুন সকালে যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ডে পথসভা ও মিছিল শেষে চট্টগ্রাম বন্দরের সামনে সমাপনী সমাবেশে মিলিত হবে।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের আবদুস সাত্তার, জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চের মাসুদ খান, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির ডা. হারুন উর রশীদ, বাসদের (মার্ক্সবাদী) রাশেদ শাহরিয়ার, বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলনের সুশান্ত সিনহা সুমন, গণতান্ত্রিক মুক্তি ইউনিয়নের লুৎফুন নেছা আঁখি, ছাত্র নেতা রায়হান উদ্দিন ও আনোয়ার হোসেন কাজ করছেন।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পরিকল্পনায় করিডোর দেওয়ার নামে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চলছে। একইভাবে চট্টগ্রাম বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে। বন্দরের উন্নয়নে বিদেশি বিশেষজ্ঞ রাখা যেতে পারে। কিন্তু বন্দর লিজ দেওয়া যাবে না। এটা দেশের মানুষের সম্মান ও স্বাধীনতার ওপর আঘাত। তাই রোডমার্চ কর্মসূচি সফল করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, জাতীয় সম্পদ, ভোটাধিকারসহ নিজেদের অধিকার রক্ষায় সচেতন দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
সিপিবি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দেশপ্রেমিক জনগণের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি কম্পানিকে লিজ দেওয়া ও রাখাইনে করিডোর দেওয়ার উদ্যোগ বন্ধের দাবি জানান।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে রাখাইনে করিডর ও লাভজনক চট্টগ্রামের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের লিজ দেওয়ার যে পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, তা গণতন্ত্রে উত্তরণের সম্ভাবনায় নানা সংকট তৈরি করছে। চট্টগ্রাম বন্দর দেশের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ।
দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি, দেশের হৃৎপিণ্ড। আমদানি ও রফতানির ৯২ ভাগ এই বন্দর দিয়ে সম্পন্ন হয়। ভৌগোলিক কারণে এই বন্দরের সঙ্গে আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা জড়িত। এই বন্দরের সবচেয়ে বৃহৎ ও লাভজনক টার্মিনাল হলো নিউমুরিং টার্মিনাল। এই বন্দর বিদেশিদের কাছে ইজারা দেওয়া হবে আত্মঘাতী। এতে বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদের ওপর বিদেশি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। বিদেশিদের নিয়োগের ফলে দেশীয় কর্মসংস্থান কমবে এবং অনেক শ্রমিক বেকার হবে।
রোডমার্চের আগের দিন বাসদ নেতা রাজেকুজ্জামান রতন দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, আমরা বন্দর ইজারা ও করিডরের বিরোধিতার পাশাপাশি বাংলাদেশে স্টারলিঙ্কের ব্যবসার সুযোগ দেওয়ারও বিরোধিতা করছি। একদিকে এই স্টারলিঙ্ক ব্যয়বহুল, অন্যদিকে আমাদের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিদেশিদের হাতে যাওয়ার আরো একটি উইনডো খুলে গেল।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামের সমাপনী সমাবেশ থেকে একটি ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে। আমরা চাইনা আমাদের সম্পদের কর্তৃত্ব বিদেশিদের হাতে যাক। বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই এখন দক্ষ, এ ছাড়া আমাদের প্রবাসী দক্ষ জনশক্তিও আছে। প্রয়োজনে তাদের এনে আমাদের ঘাটতির জায়গাগুলো পূরণ করা যায়। সরকারকে এসব মানতে হবে।
কেকে/ এমএস