আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে সরকার। বরাবরের মতোই এ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে সব মহলে। সরকারের এই একটা কাজ নিয়েই দেশের সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের আগ্রহ ও উদ্বেগ থাকে। কারণ এর সঙ্গে তাদের আয়ব্যয় হ্রাসবৃদ্ধির সম্পর্ক জড়িত। কৃষক-শ্রমিক-শ্রমজীবী সবাইকেই ভালোমন্দে স্পর্শ করে জাতীয় বাজেট। ২০২৫-২৬-এর প্রস্তাবিত বাজেটও সংগত কারণেই আলোচনা-সমালোচনার তোপ থেকে মুক্ত নয়। প্রাথমিক ত্রুটি হচ্ছে, এটা একটা ঘাটতি বাজেট। আয়ের থেকে ব্যয় বেশি। অর্থ উপদেষ্টা যদিও বলেছেন, এটা মধ্যবিত্তেরই বাজেট। জনবান্ধব। সীমিত সম্পদে বিস্তর চাহিদার সমন্বয়ে করা এ বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য।
কিন্তু সিপিডির বিশ্লেষণ হচ্ছে—‘এতে কর্মসংস্থান ও বৈষম্য কমানোর সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেই। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব প্রতিফলিত হয়নি। উন্নয়ন বাজেট পুরোটাই ঋণনির্ভর।’ জাতীয় নাগরিক পার্টি বলেছে, সরকার বর্তমান সময়ের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারলেও তার সঠিক সমাধান বা কৌশল প্রণয়ন করতে পারেনি। আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়, বেসরকারি বিনিয়োগ, মূল্যস্ফীতি এবং জিডিপির যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়াতে করকাঠামোয় প্রয়োজনীয় সংস্কার দেখা যায়নি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেট ব্যবসাবাণিজ্য ও বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে আশাব্যঞ্জক নয়।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বিনিয়োগের বাধা কাটানোর লক্ষ্যে বাজেটে কোনো বার্তা নেই। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্লেষণ—প্রস্তাবিত বাজেট বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশা পূরণ ব্যর্থ হবে। খোদ অর্থ মন্ত্রণালয়ই বলছে, বাজেট বাস্তবায়নে মধ্য মেয়াদে অন্তত সাতটি চ্যালেঞ্জ দেখছে তারা। সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি-বিবৃতিতে তারা চ্যালেঞ্জগুলোর উল্লেখও করেছে। এসব চ্যালেঞ্জ সম্মিলিত-সমন্বিত প্রচেষ্টায় মোকাবিলা করতে হবে। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সাম্য, সমৃদ্ধি, মর্যাদার অর্থনীতি গঠনই হোক আজ আমাদের বিশ্বমঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দৃঢ় অঙ্গীকার।
ভারসাম্যপূর্ণ এবং জনমুখী একটি বাজেটই পারে দেশের অর্থনীতিকে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে। সম্প্রতি ঘোষিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘিরে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সরকারের উপদেষ্টামহল একে জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব বলে দাবি করেছে। অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এবং বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) মতো সংগঠনগুলো তীব্র সমালোচনা করে এর নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরেছে।
তাদের বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থনীতির প্রধান সংকটগুলো আমলে নেওয়া হয়নি। একইভাবে আমলে নেওয়া হয়নি সাধারণ মানুষের সংকট কিংবা ব্যবসায়ীমহলের সংকট। বড় শিল্পের কাঁচামালের ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে দেওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। ফলে বাড়বে পণ্যের দাম আর সেই বোঝা বইতে হবে সাধারণ মানুষকে।
নির্মাণসামগ্রীর ভ্যাট বাড়ায় আবাসন ও নির্মাণ শিল্পে খরচ বেড়ে যাবে। এসব কারণে দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়বে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেটকে ‘সীমিত সম্পদ ও অনেক চাহিদার মধ্যে’ আনা হয়েছে বলে দাবি করেছেন। তবে সিপিডি বলছে, চলমান অর্থনৈতিক সংকটকে আমলেই নেওয়া হয়নি।
বিশেষ করে করকাঠামো নিয়ে তীব্র অসন্তোষ দেখা গেছে। বার্ষিক ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের মানুষকে ১২.৫ শতাংশ, ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৬.৭ শতাংশ, কিন্তু ৩০ লাখ টাকার বেশি আয়কারীদের মাত্র ৭.৬ শতাংশ কর দিতে হবে। এই বৈষম্যমূলক করবিন্যাস নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে। সিপিডি একে ‘বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের’ অঙ্গীকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেছে। অন্যদিকে বিজিএমইএ ও বিসিআই নতুন বিনিয়োগের পথ রুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
শিল্পে কর অব্যাহতি সুবিধা কমানো এবং কাঁচামালের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব উৎপাদন খরচ বাড়াবে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দিতে পারে। বিসিআই সভাপতি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে চললে শিল্প ক্ষতির মুখে পড়বে।’ রফতানিমুখী শিল্পের প্রণোদনা কমানোর ইঙ্গিতও রফতানি সক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি তৈরি করছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান কালের কণ্ঠের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ঘোষিত বাজেট নিয়ে বলেছেন, ‘বাজেটে সমস্যাগুলোর স্বীকৃতি থাকলেও কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো রয়ে গেছে। রাজস্ব সংগ্রহের সীমাবদ্ধতা, ব্যয়ের অদক্ষতা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতা— এসব পুরোনো সমস্যার বিরুদ্ধে এবারও কোনো দৃশ্যমান সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।’
আমি মনে করি, প্রস্তাবিত বাজেটে বৈষম্য দূরীকরণ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে, তা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। জনগণের ওপর করের বোঝা না চাপিয়ে, বরং করের আওতা বৃদ্ধি এবং অপচয় রোধের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া উচিত ছিল। পাশাপাশি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
দেশের শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য—সব ক্ষেত্রেই এক মারাত্মক আস্থাহীনতা বিরাজ করছে। নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। অথচ দেশে বেকার তরুণের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। পুরোনো অনেক শিল্প-কারখানাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
অনেকগুলো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। চলছে শ্রমিক ছাঁটাই। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের চাপে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠে গেছে। এর মধ্যে সোমবার ঘোষিত হয়েছে গতানুগতিক বাজেট।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাজেটে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার দিকনির্দেশনা নেই। বিনিয়োগ উৎসাহিত করার কিংবা ঝুঁকিতে থাকা শিল্পগুলোকে পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা নেই। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জীবনমান উন্নয়নের পদক্ষেপ নেই। বরং জরুরি কিছু ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রত্যাহার ও অতিরিক্ত করারোপের ফলে চূড়ান্তভাবে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে।
গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার উৎখাতের পর মানুষ পুরোনো অনেক ব্যবস্থার পরিবর্তন আশা করেছিল। কিন্তু গতানুগতিক এই বাজেটে পুরোনো প্রায় সব ব্যবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। বরং কিছু ক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। কিছু ক্ষেত্রে শুল্ক-কর আরোপের মাধ্যমে বেসরকারি খাতের ব্যবসা করার সুযোগ আরো কঠিন করা হয়েছে। বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এর ফলে বিদ্যুৎ-জ্বালানি ব্যয়বহুল হবে। এতে শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়বে। তখন শিল্পের টিকে থাকা আরো কঠিন হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। অন্যদিকে উৎপাদন খরচ বাড়লে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়বে এবং তা ভোক্তার ওপর আরো চাপ বাড়াবে। অটোমোবাইল খাতে খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে, তাতে এ খাতের স্থানীয় উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। কটন সুতার উৎপাদন পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট কর প্রতি কেজিতে তিন টাকা থেকে বাড়িয়ে পাঁচ টাকা করা হয়েছে। কৃত্রিম আঁশ ও অন্যান্য আঁশের মিশ্রণে তৈরি সুতার সুনির্দিষ্ট কর একই হারে বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া টার্নওভার কর ০.৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি করেছেন ডিসিসিআই সভাপতি। ইন্টারনেট ব্যবহারে খরচ কমলেও স্থানীয়ভাবে মোবাইল ফোন উৎপাদনে ভ্যাট বাড়ানোয় এ শিল্পের বিকাশ ব্যাহত হবে বলেও মনে করা হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘গুণগত দিক থেকে এই বাজেটে আমরা কোনো কিছু পরিবর্তন দেখিনি। শুধু বাজেটের সংখ্যা সামান্য কিছু কমেছে। কিন্তু বাজেট কাঠামো একই রয়ে গেছে। সুতরাং এটা আগামী দিনে সরকারের জন্য খুব একটা সহজ কিছু হবে না।’ অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, এই বাজেটে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কার্যকর কিছুই নেই। তারা যে সংকটে আছে, সেই সংকটকে চিহ্নিত করেই বাজেট পরিকল্পনা হওয়া উচিত ছিল। মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে, কিন্তু বাজেটে সেই চাপ লাঘবে কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেই।
আমরা আশা করি, বাজেট নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে যেসব সমালোচনা হবে, যেসব পরামর্শ আসবে, সেগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। বাজেটকে জনপ্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করতে হবে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও ভাষা সংগ্রামী
কেকে/এএম