শীর্ষ বিজ্ঞানী ও সেনাকর্মকর্তাসহ ছয় শতাধিক মৃত্যু ও তিন পরমাণু কেন্দ্রসহ অনেক স্থাপনা বিধ্বস্ত হওয়ার পরও ইরানে বইছে যুদ্ধজয়ের আনন্দ। শক্তিধর ইসরায়েল ও মহাশক্তিধর যুক্তরাষ্ট্রকে রুখে দেওয়ার গৌরবে উচ্ছ্বসিত সারা দেশের মানুষ। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সমরাস্ত্রে অগ্রসর ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র চালিয়ে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি যেন অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাদপদ ইরানের জন্য নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে।
অন্যদিকে ইসরায়েলে হাজার হাজার মানুষ বসতি হারিয়ে বিপাকে। সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণের আবেদন করেছে সেদেশের ৩৯ হাজার মানুষ। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও আবেদন করেননি, তাদের ধরলে এ হিসাবটা আরো অনেক বড় হবে। ইরানের সঙ্গে ১২ দিনের সংঘাতে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির চাপ সামলাতে হবে ইসরায়েলকে। এসবের মাঝে আবার গাজায় সাত ইসরায়েলি সৈন্যের মৃত্যুর শোকে কাতর দেশ।
যুদ্ধবিরতির পর ইরান-ইসরায়েলে ভিন্ন চিত্র:
মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী রাষ্ট্র ইসরায়েল ও তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের মধ্যে ১২ দিনের সংঘাতের পর গত মঙ্গলবার যুদ্ধবিরতি হয়। এ সংঘাতে প্রভূত ক্ষতি হয়েছে ইরানের, মৃত্যু হয়েছে ছয় শতাধিক মানুষের। এ ছাড়া তাদের তিনটি পরমাণুকেন্দ্রসহ সব কটি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা ফেলেছে ইসরায়েল। পরে আরো শক্তিশালী বোমায় বিধ্বস্ত করেছে ইসরায়েলের পরম বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র। বি-২ স্টেলথ বিমান ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে বাংকার বাস্টার বোমায় বিধ্বস্ত করেছে ইরানের কয়েক শতকের চেষ্টায় গড়া এসব পারমাণবিক স্থাপনা। তারপরও তেহরানসহ ইরানের শহরগুলোতে যেন উৎসব চলছে। এ উৎসব আগ্রাসী শক্তিগুলোকে রুখে দেওয়ার। মঙ্গলবার রাতে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে উল্লাস করেছে।
তবে বুধবারও কম সামর্থ্য নিয়ে ইরানের বীর যোদ্ধাদের কৌশল ও ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইসরায়েলকে ঘায়েল করার আনন্দ পুরো ইরানে। মানুষজন ফিরতে শুরু করেছে শহরে, কেউবা আত্মীয়দের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন বা ছুটে যাচ্ছেন বন্ধুদের বাড়িতে। মানুষ ফিরতে শুরু করেছে হোটেল-রেস্তোরায় ও বাজারে।
অন্যদিকে ইসরায়েলিদের পেয়ে বসেছে বিষণ্নতায়। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেকগুলো যুদ্ধে লড়েছে ইসরায়েল। আরবদের সঙ্গে তিনটি যুদ্ধে এমন মার খায়নি দেশটি। তাদের বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দম্ভ ধুলোয় মিশে গেছে। আয়রন ডোম আর এ্যারোকে ফাঁকি দিয়ে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইসরায়েলের উত্তর-দক্ষিণ ও কেন্দ্রস্থলে বিধ্বস্ত হয়েছে হাজার হাজার বাড়িঘর। বসতি হারিয়ে হাজার হাজার মানুষ তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে। লাখ লাখ ইসরায়েলি হতবাক, কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং হতাশায় ডুবে আছে। ১২ দিনের অনিরাপত্তা তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ক্ষেপণাস্ত্রের শব্দ তাদের কানে বেজে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে। অনেকে এর জন্য দোষ দিচ্ছেন নেতানিয়াহুকে, তিনি ইরান আক্রমণ করে বেকায়দায় ফেলেছেন সাধারণ মানুষকে।
সাত সেনার মৃত্যুতে কাতর ইসরায়েল:
ফিলিস্তিনের গাজার দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনিস এলাকায় একটি সাঁজোয়া যান বিস্ফোরণে সাত ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। বুধবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন।
আইডিএফ-এর এক বিবৃতিতে বলা হয়, মঙ্গলবার (স্থানীয় সময়) খান ইউনিস শহরে সেনাদের বহনকারী সাঁজোয়া যানটি বিস্ফোরিত হয় এবং তাতে আগুন ধরে যায়।
নিহত সেনাদের মধ্যে ছয়জনের নাম প্রকাশ করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এদের বয়স ১৯ থেকে ২১ বছরের মধ্যে।
আইডিএফ জানায়, হামলায় ব্যবহৃত বিস্ফোরকটি সাঁজোয়া যানটির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, যা প্রচণ্ড আঘাতে বিস্ফোরিত হয়।
এ ঘটনায়ও কাতর হয়ে গেছে ইসরায়েলিরা, যদিও এর আগে একদিনে সর্বোচ্চ ২০ সেনার মৃত্যুরও রেকর্ড আছে। ইসরায়েলিরা আজ দিশেহারা। স্কুল-কলেজ ও অফিস খুলেছে, বিমানসহ পরিবহনও চলতে শুরু করেছে আগের মতোই। তবে এরই মধ্যে কি যেন হয়ে গেছে দেশটিতে। মানুষ কথা বলছেন কম, শপিং মলগুলো ফাঁকা, সিনেমা হলগুলোতে লোক নেই, রেস্তোরাঁয় আড্ডা জমছে না।
আইএইএকে সহযোগিতা স্থগিত করল ইরান:
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত-সংক্রান্ত একটি বিল অনুমোদন করেছে ইরানের পার্লামেন্ট। গতকাল বুধবার বিলটি অনুমোদন দেওয়া হয় বলে জানিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম নুর নিউজ।
ইসরায়েলের সঙ্গে টানা ১২ দিনের সংঘাতের পর ইরান এমন সিদ্ধান্ত নিলো। ইসরায়েলের দাবি, তারা তেহরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা থেকে বিরত রাখতে চায়। অন্যদিকে তেহরানের দাবি, শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে তারা পারমাণবিক কর্মসূচি চালাচ্ছিল।
বিলটিকে আইনে পরিণত করতে ইরানের গার্ডিয়ান কাউন্সিলের অনুমোদন নিতে হবে। বিলে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে আইএইএ যদি ইরানের কোনো পারমাণবিক স্থাপনা পরিদর্শন করতে চায়, সেক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের অনুমোদন নিতে হবে।
চলতি সপ্তাহে ইরানের পার্লামেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি বিলটির সাধারণ কাঠামো অনুমোদন করেছে। কমিটির মুখপাত্র জানান, এই বিল কার্যকর হলে ইরানে নজরদারি ক্যামেরা স্থাপন, পরিদর্শন এবং আইএইএর কাছে প্রতিবেদন দাখিল স্থগিত করা হবে।
বিল অনুমোদনের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি আইএইএ। তবে সংস্থাটির প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বলেছেন, ইরানে পরিদর্শকদের আবার পাঠানোর চেষ্টা করছেন তিনি। বিশেষ করে, ১৩ জুন ইসরায়েলের হামলার আগপর্যন্ত যেখানে তেহরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছিল সেখানে।
ক্ষতিপূরণ চেয়ে ৩৯ হাজার ইসরায়েলির আবেদন:
ইরানের একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র-ড্রোন হামলায় পর্যুদস্ত ইসরায়েলিরা এখন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইছেন। এ জন্য প্রায় ৩৯ হাজার আবেদন জমা পড়েছে। ইরানি হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য একটি ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠন করেছে ইসরায়েলের কর কর্তৃপক্ষ। ১৩ জুন ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত শুরুর পর থেকে এ তহবিল থেকে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মোট ৩৮ হাজার ৭০০টি আবেদন জমা পড়েছে।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ঘরবাড়ি-ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন জমা পড়েছে ৩০ হাজার ৮০৯টি। এ ছাড়া ৩ হাজার ৭১৩টি আবেদন জমা পড়েছে যানবাহনের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার কারণে। যন্ত্রপাতি আর অন্যান্য জিনিস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন জমা পড়েছে ৪ হাজার ৮৫টি।
ইসরায়েলি ওয়েবসাইট বেহাদ্রেই হারেদিমের তথ্যমতে, শুধু তেল আবিবেই ক্ষতিপূরণ চেয়ে ২৪ হাজার ৯৩২টির বেশি আবেদন জমা পড়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের আশকেলন শহরে আবেদন জমা পড়েছে ১০ হাজার ৭৯৩টি।
ইরানে নিহত কমান্ডার-বিজ্ঞানীদের জানাজা শনিবার:
ইসরায়েলের হামলায় নিহত ইরানের জ্যেষ্ঠ সামরিক কমান্ডার ও শীর্ষ বিজ্ঞানীদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জানাজা আগামী শনিবার অনুষ্ঠিত হবে।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার এক দিন পর গতকাল বুধবার ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ১২ দিন ধরে চলা ইহুদি রাষ্ট্রের আগ্রাসনে শহিদ কমান্ডার ও বিজ্ঞানীদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জানাজা আগামী শনিবার রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত হবে। স্থানীয় সময় সকাল ৮টা থেকে এই আয়োজন শুরু হবে।
সংঘাতে ইরানের অন্তত ১৪ জন বিজ্ঞানীকে হত্যা করার দাবি করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন ইরানের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাও।
যুদ্ধবিরতিতে এখনো স্বীকৃতি দেননি খামেনি:
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির বিষয়টি মঙ্গলবার দেশটির প্রেসিডেন্টসহ সিনিয়র কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছিলেন। কিন্তু এর পরেও দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির দিক থেকে বিষয়টি স্বীকার করে প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য আসেনি।
দেশটির কোনো বিষয়ে তার বক্তব্যই শেষ কথা। সে কারণে দেশটির ভেতরে ও বাইরে থেকে এখন নজর দেওয়া হচ্ছে, যে তিনি এ বিষয়ে কখন কথা বলেন।
খামেনি তেহরানে তার নিয়মিত বাসবভনে অবস্থান না করে নিরাপদ বাঙ্কারে অবস্থান করছেন- এমন খবর আগেই এসেছে, যদিও তা ইরান নিশ্চিত করেনি।
সবশেষ গত ১৮ জুন তার আগে থেকে রেকর্ড করা একটি ভিডিও বার্তা টেলিভিশনে প্রচার হয়েছে। ওই ভাষণে তিনি ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’ করতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে আহ্বান জানিয়েছিলেন তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে স্বস্তি নিয়ে এলেও এক ধরনের সন্দেহ-উদ্বেগ রয়েছে। এর আগে বিভিন্ন সংঘাতে যুদ্ধবিরতি ভেঙে হামলা চালানোর নজির আছে তেল আবিবের।
কেকে/ এমএস