ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে। দুই দেশের ভূখণ্ডে একাধিক হামলা ও পাল্টা হামলার পর ইরানের পক্ষ থেকে একথা জানানো হয়েছে। এদিকে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ‘ইসরায়েল ও ইরান পুরোপুরি ও সর্বাত্মক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।’ ট্রাম্পের অনুরোধে কাতার ইরানকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করায়। তবে যুদ্ধবিরতির আগে শেষবারের মতো ইরান ও ইসরায়েল একে-অন্যকে ভয়াবহ আক্রমণ চালায়। গতকালের আক্রমণে ইরানে ১০ জন ও ইসরায়েলের ৬ জনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে।
১২ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলের বোমা হামলায় ইরানের শীর্ষ সেনা কমকর্তাসহ ৬ শতাধিক মানুষের জীবন গেছে। অন্যদিকে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের অর্ধশত মৃত্যু হলেও তাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশি। এরই মধ্যে ৪০ হাজার মানুষ ক্ষতিপূরণ চেয়েছে ইসরায়েল সরকারের কাছে। ইসরায়েলের পরম বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের ইরানে হামলা, পরে যুদ্ধবিরতি সর্বাত্মক চেষ্টা এবং ইসরায়েলের প্রথম সম্মতিতে প্রমাণ করে, যুদ্ধে জিতেছে ইরান। তাদের ত্যাগ এবং ক্ষতির মুখে পড়েও লড়াকু মনোভাব শত শত বছর গরিব দেশ ও জাতির জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
ইরান-ইসরায়েলের সংঘাতের শেষ দিন মৃত্যু ১৬ জন: ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের বিরসেবা শহরে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ছয়জনে পৌঁছেছে। বিরসেবার অগ্নিনির্বাপক ও উদ্ধারকারী সংস্থার মুখপাত্র লিনয় রেশাফ বলেছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকরের কয়েক ঘণ্টা আগে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিধ্বস্ত একটি ভবনে আটকা পড়েন কয়েকজন। বিরসেবায় ইরানের হামলায় ২২ জন আহত হয়েছে।
যুদ্ধবিরতি কার্যকরের আগে ইরানের বিভিন্ন জায়গায় ইসরায়েলি হামলায় দেশটির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাসহ ১০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৩৩ জন। নিহত ওই কর্মকর্তার নাম নেদা রাফিয়ি পারসা। তিনি ইরানের বিদ্যুৎ উৎপাদক সংস্থা তাভানিরের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক ছিলেন। তিনি দায়িত্ব পালনকালে হামলায় নিহত হন বলে এক্স পোস্টে জানিয়েছে দেশটির মেহর সংবাদমাধ্যম।
দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের গিলান প্রদেশের চারটি আবাসিক এলাকায় পৃথক ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৯ জন বেসামরিক ইরানি নিহত হয়েছেন। হামলাস্থলের আশপাশের আবাসিক ভবনগুলোয় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আহত হয়েছেন মোট ৩৩ জন। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। হতাহতদের মধ্যে ১৬ জন নারী ও শিশু রয়েছেন।
যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করায় নেতানিয়াহুর ওপর ‘বিরক্ত’ ট্রাম্প: ইরানে হামলা চালিয়ে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর ‘অত্যন্ত বিরক্ত’। সম্ভবত তিনি মনে করছেন, নেতানিয়াহু ‘বিশ্বাসভঙ্গ’ করছেন। ইউরোপে ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দিতে রওনা হওয়ার আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প জানান, যুদ্ধবিরতির শর্ত ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা লঙ্ঘন করায় তিনি ইসরায়েল ও ইরান-দুই পক্ষের প্রতিই ক্ষুব্ধ। তবে তার অতিরিক্ত রাগটা যে ইসরায়েলের দিকে ছিল, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। তিনি আরো বলেন, ‘ট্রাম্প স্পষ্টতই বেশ বিরক্ত এবং সম্ভবত নেতানিয়াহু বিশ্বাসভঙ্গ করেছেন, এমন বোধ করছেন।’
যুদ্ধবিরতির জন্য নেতানিয়াহুর সমর্থন পেতে ট্রাম্প সোমবার তার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এরপর ইরানের সমর্থন পেতে কাতারের সহযোগিতা নেন তিনি।
ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত ৬১০ জন নিহত: ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান সংঘাতে ইরানে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬১০ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে তেহরান। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হোসেইন কেরমানপুর গতকাল মঙ্গলবার এক্সে (সাবেক টুইটার) দেওয়া পোস্টে এ তথ্য জানান বলে এএফপির খবরে বলা হয়। তিনি জানিয়েছেন, ইসরায়েলের হামলায় আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৭০০’র বেশি মানুষ।
হোসেইন কেরমানপুর বলেন, ‘গত ১২ দিনে আমাদের হাসপাতালগুলো অত্যন্ত মর্মান্তিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে।’
অন্যদিকে ইসরায়েল তাদের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে অনেক রাখঢাক করছে। ১২ দিনে তারা মাত্র ২৮ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছে। তবে ১২ দিনে তাদের উত্তরের হাইফা, দক্ষিণের বিরসেবা এবং কেন্দ্রের তেল আবিবসহ বহু এলাকা বিধ্বস্ত হয়েছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে। বহু বহুতল ভবন আর বসবাসের অবস্থায় নেই। দেশটির ৪০ হাজার মানুষ ক্ষতিপুরণ চেয়েছে, ক্ষতিতে পড়েও চায়নি আরো হাজার হাজার মানুষ। সে হিসাবে তাদের প্রাণহানি এত কম হওয়ার কথা নয়।
ইসরায়েল আগে হামলা না করলে ইরানও করবে না: ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি মানলে ইরানও তা মেনে চলবে বলে জানিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান। ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ইরান যুদ্ধবিরতি মেনে চলবে যতক্ষণ ইসরায়েল তা মেনে চলে। তিনি আরো বলেন, ইরান সংলাপের জন্য প্রস্তুত। তেহরান আলোচনার টেবিলে বসেই ইরানি জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবে।
‘লক্ষ্যপূরণ’ হওয়ায় ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে: ইসরায়েল সরকার বলেছে, ইরানে হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে নিজেদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জন হওয়ার পরই দেশটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে এমন দাবি জানিয়েছে ইসরায়েল সরকার।
ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ‘দ্বিমুখী হুমকি’ দূর করেছে। ইসরায়েল ইরানের সামরিক নেতৃত্বকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং দেশটির সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু স্থাপনা ধ্বংস করেছে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘প্রতিরক্ষায় সহযোগিতা এবং ইরানের পারমাণবিক হুমকি থামাতে সহযোগিতার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে ইসরায়েল।’
সরকারের ওই বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও মোসাদের প্রধানের সঙ্গে গতকাল রাতে আলোচনা করেছেন। মন্ত্রিসভার সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে নেতানিয়াহুর। সেখানে বলা হয়েছে, ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’-এ সব লক্ষ্যপূরণ হয়েছে ইসরায়েলের। লক্ষ্যের চেয়ে বেশি কিছু অর্জন হয়েছে।’
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তেহরানের আকাশসীমার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার পরও যুদ্ধবিরতি: ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার প্রতিশোধ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায় ইরান। সোমবার রাতে কাতারের আল উদেইদ বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। এই অঞ্চলে এটাই যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি। কাতার জানিয়েছে, তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সফলভাবে হামলা প্রতিহত করেছে। কাতারের রাজধানী দোহার আকাশে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। পরে কাতারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, আল উদেইদ ঘাঁটি লক্ষ্য করে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র তারা প্রতিহত করেছে। ইরান থেকে মাত্র ১৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত গ্যাস-সমৃদ্ধ দেশ কাতার।
দোহার বাইরে মরুভূমিতে অবস্থিত এই ঘাঁটিতে প্রায় ১০ হাজার মার্কিন সৈন্য অবস্থান করে। কাতার এই ঘাঁটির অবকাঠামো উন্নয়নে এ পর্যন্ত ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করেছে। এটি ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ডের (সেন্টকম) সম্মুখভাগের সদর দপ্তর। এখান থেকেই মিসর থেকে কাজাখস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল এক অঞ্চলের মার্কিন সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়। এখানে কাতার ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের বিমানবাহিনীর উপস্থিতি আছে। এএফপি জানায়, হামলার আগে আল উদেইদ ঘাঁটির রানওয়ে থেকে কয়েক ডজন মার্কিন সামরিক বিমান সরিয়ে নেওয়া হয়। জুনের শুরুতে যেখানে প্রায় ৪০টি পরিবহন ও গোয়েন্দা বিমান দেখা গিয়েছিল, ১৯ জুনের ছবিতে সেখানে মাত্র তিনটি বিমান দেখা যায়।
একজন মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, যেসব বিমান সুরক্ষিত হ্যাঙ্গারের বাইরে ছিল, সেগুলোকে সরিয়ে নেওয়া হয়। পাশাপাশি, বাহরাইনে মার্কিন নৌবাহিনীর পঞ্চম নৌবহরের জাহাজগুলোকেও বন্দর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
তবে ইরানে হামলার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের কোনো ঘাঁটি ব্যবহার করেনি যুক্তরাষ্ট্র। পেন্টাগন জানিয়েছে, হামলার জন্য বি-২ বোমারু বিমানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের হোয়াইটম্যান এয়ার ফোর্স বেস থেকে সরাসরি আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ইরানে উড়ে যায়।
ইরান ও ইসরায়েল দুপক্ষই তাদের শক্তি ও ঘাটতি বুঝেছে: ইসরায়েল নিজেদের মনে করত বিশ্বে অপরাজেয় শক্তি। আরব দেশগুলোকে তিনবার হারিয়ে তারা তাদের গুরু যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া কাউকে গুরুত্ব দিত না, গোনায় নিত না। তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বলা হয় বিশ্বের সর্বাধুনিক। সেই দম্ভ এবার গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইরান। শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে তাদের উত্তর-দক্ষিণ সব এলাকায় ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে। ধসে পড়েছে হাজার হাজার ঘর-বাড়ি। মানুষজনকে বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয়েছে সুরক্ষা বলয়ে। তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকানোর সব প্রযুক্তি ব্যর্থ হয়েছে। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এবারই প্রথম তারা এত বড় মার খেলো।
অন্যদিকে ইরানো নতুন প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকারী হয়ে নিজেদের মধ্যপ্রাচ্যের সেরা শক্তি ভাবত। তারা ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তার প্রমাণও রেখেছে। তবে আকাশ প্রতিরক্ষা ও বিমান শক্তি যে দুর্বল সেটা এবার ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে টের পেয়েছে। তার চেয়ে বেশি বুঝেছে, দেশের ভেতরে শত্রু থাকলে বিদেশি শত্রুরা তার পুরো ফল ভোগ করে। সংঘাতের প্রথম দিনেই ইসরায়েল তাদের প্রায় শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাকে ঘায়েল করেছে ইসরায়েল। ইরানের ভেতরে ইসরায়েলের শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের কারণেই তা সম্ভব করতে পেরেছে ইসরায়েল। আর এ নেটওয়ার্কে তথ্য জুুগিয়েছে সরকারবিরোধী ইরানিরা। ইরানে যে সরকারবিরোধীদের ওপর ভয়ানক দমন-নির্যাতন চালিয়েছে সরকার, তার মূল্য দিতে হয়েছে শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা ও শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীদের হারিয়ে।
কেকে/এআর