২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পর তা ঘিরে অর্থনৈতিক বাস্তবতা, কাঠামোগত দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক শূন্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। উচ্চ রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বরাদ্দের ঘাটতি, সামাজিক নিরাপত্তা ও নারীর অংশগ্রহণে সংকোচন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাধাসহ নানা দিক থেকে বাজেটের কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও পেশাজীবীরা।
তারা মনে করছেন, রাজনৈতিক শূন্যতা ও বাজেট বাস্তবায়নে দক্ষতা, দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে, যার ফলে নতুন বাজেটেও পুরোনো চ্যালেঞ্জগুলোই আরো প্রকটভাবে হাজির হয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির উদ্যোগে শনিবার ঢাকার সিরডাপ অডিটোরিয়ামে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে ‘বাজেট বিতর্ক : প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সেমিনারে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘বর্তমান বাজেটটি একটি রাজনৈতিক শূন্যতার বাজেট, যেখানে একই সঙ্গে সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং লুণ্ঠিত হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিগত রাজনৈতিক সরকারগুলোর দুর্নীতির চক্রের পরিধি ভেঙে প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায়। তারা চায় তাদের তৈরি টেমপ্লেটটি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকার অনুসরণ করবে।’
তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট আমলে জানেনই তো ব্যবসা করতে পারি নাই, এখন একটু খেয়াল রাখবেন। তো আমরা সে পথে যাচ্ছি না। আমরা চেষ্টা করছি যে অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা। যেই ব্যবসা পাবেন, প্রতিযোগিতা হবে সেখানে। আমরা সবকিছু উন্মুক্ত করে দিয়েছি। আসছে জুলাই-আগস্টে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ্ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত বাজেট আপাতদৃষ্টিতে গতানুগতিক মনে হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। যা নির্ধারণ করতে পারে বাজেটের আয়প্রবাহ কোন উৎস হতে আসবে আর কোন জনগোষ্ঠীর জন্য কোন কোন খাতে অর্থ ব্যয় হবে।
বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শাফিউন নাহিন শিমূল প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের উদাহরণ টেনে স্বাস্থ্য বাজেটকে খাতওয়ারি খরচ হিসাবে চিন্তা না করে মানবসম্পদ উন্নয়নের একটি স্মার্ট বিনিয়োগ হিসাবে গুরুত্ব আরোপ করেন এবং এক্ষেত্রে ঘোষিত বাজেটের স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জিডিপির ১.৭ শতাংশকে অপ্রতুল মনে করেন।
বাজেটে শিক্ষাখাতের বরাদ্দ নিয়ে বিশ্লেষণ করে বিআইডিএস’র গবেষণা পরিচালক জুলফিকার আলি মনে করেন, শিক্ষা ও কর্মখাতের যে অসামঞ্জস্য বিরাজমান তা দূরীকরণে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষায় আরো বরাদ্দ দেওয়া উচিত। তাছাড়া বর্তমান সরকারের উদ্যোগে শিক্ষা কমিশন না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, বাজেটের কয়েকটি খাতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। তাছাড়া বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেসরকারি খাতে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভবিষ্যৎ সমস্যা তৈরি করবে।
জাতীয় বাজেটকে রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল হিসেবে অভিহিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। তিনি বলেন, জনগণের অর্থের ওপর জনগণের মালিকানা পুনঃপ্রতিষ্ঠার করতে হবে।
আইসিবি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, যথাযথ সংস্কার ছাড়া ট্যাক্সের অনুপাত বৃদ্ধি পেলে তা শুধু দুর্নীতি ও অদক্ষতার অর্থায়নে পরিণত হবে। অর্থবাজারের সীমানা পেরিয়ে পুঁজিবাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা সুদিন ফিরিয়ে আনতে পারে।
ব্যবসায়ী নেতা ও বিএনপির সহসভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময় মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য কাজ করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব প্রতিষ্ঠান জনকল্যাণমুখী করবে বলে প্রত্যাশা তার। সামাজিক শৃঙ্খলা ছাড়া কোনো ব্যবসায়ী বিনিয়োগ করবেন না বলেও মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ‘বেসরকারি’ খাতের জন্য সংকোচন নীতি নেওয়া হলেও সরকারের জন্য তা দেখছেন না। আমরা মূল্যস্ফীতিকে দমন করার জন্য সুদের হার বাড়িয়ে দিচ্ছি। ভালো কথা। আমরা সংকুচিত রাজস্ব নীতি করতে গিয়ে বাজেটের আকার ৭ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কী, যে এটা বেসরকারি খাতের জন্য, বেসরকারি খাতের জন্যই শুধু সংকুচিত মুদ্রানীতি এবং সংকুচিত রাজস্ব নীতি। যেই মাত্র এটা সরকারের জন্য, সরকারের জন্য আসে তখন আর এটা ওদের (সরকারের) জন্য সংকুচিত না।’
আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘গত দেড় বছরে বাংলাদেশে মোট ৩ লাখ কোটি টাকা ব্যাংকে আমানত পাইছে। এর ভিতরে ২ লাখ ৭০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে সরকার। তো তাদের জন্য সংকুচিত রাজস্বনীতি তো আমি দেখতেছি না।’
প্রস্তাবিত বাজেটেও অর্থনীতির চিহ্নিত সমস্যার সংস্কার দেখা না যাওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘একদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কম, আরেক দিক থেকে মূল্যস্ফীতি বেশি। এ দুইটার সমন্বয়ের যে পরিস্থিতি আমরা দেখছি আমাদের দেশে, সেটা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কিছু সংস্কার করা যেত এই বাজেটে। কিন্তু সেটা আসলে আমি দেখি নাই।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য মোহা. ফরিদ উদ্দীন খান বলেন, দেশের প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা ছাড়া কোনো বাজেটই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অরাজনৈতিক হওয়ায় বাজেটের রাজনৈতিক আলোচনা কিছুটা নিরর্থক। তবে এ বাজেট ও এর বাস্তবায়ন গবেষণার বিষয় হতে পারে যা সময়ের দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক অতনু রব্বানী বলেন, সরকারি সেবা নিতে ঘুষ দিতে হলে জনগণ কেন কর দিতে চাইবে। সরকারের সক্ষমতা বৃদ্ধি ব্যতীত রাজস্ব বৃদ্ধি ফলপ্রসূ হবে না।
কেকে/ এমএস