২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার অনেকটা ছোট। তবে অনেক বিষয় নতুন সংযোজন করা হয়েছে। ভালোর মধ্যে অনৈতিক একটা কাজ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, সিপিডি। তবাড়ি বা হাউজিং কাজে ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখাকে সিপিডি নৈতিক অবক্ষয় বলে আখ্যা দিয়েছে। এ ধরনের সুযোগ জুলাই-আগস্ট বৈষম্যবিরোধী বিপ্লবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মত তাদের।
মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০২৫-২৬ : সিপিডির পর্যালোচনা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এ অভিমত তুলে ধরেন।
ড. ফাহমিদা বলেন, ভৌত অবকাঠামো খাতের মধ্যে পরিবহন, বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ ভালো রয়েছে। আবার জুলাই যোদ্ধাদের করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ ২৫ হাজার করা হয়েছে। সেটাও ভালো উদ্যোগ। বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ ৭৫ হাজার করা হয়েছে। যা ছিল ৩ লাখ ৫০ হাজার। সেই দিক থেকে এটা ভালো।
তিনি বলেন, শিল্পের ক্ষেত্রে কিছু ভালো উদ্যোগ লক্ষ্য করা গেছে। তবে অল্প কিছু শিল্প খরচ বাড়ায় চাপে পড়বে। শুল্ক কমাতে হবে। এ জন্য ব্যবসা পরিচালনা খরচ বাড়বে। ক্ষতি পোষাতে সাশ্রয়ী ঋণ ও বিদ্যুৎ ও জ্বালানির তুলনামূলক সস্তা সরবরাহ থাকা দরকার।
বাজেট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যর্থ : আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো সমাধানে সক্ষম নয়, এমনটাই মনে করছে সিপিডি। তাদের মতে, এ বাজেট দেশের জনগণ ও ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশিত সমাধান দিতে পারত, কিন্তু তা পারেনি।
সিপিডির বিশ্লেষণে বলা হয়, প্রস্তাবিত বাজেট আকারে তুলনামূলক ছোট হলেও এতে অবকাঠামোর পরিবর্তে জনগণকেন্দ্রিক উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রবৃদ্ধির বদলে সামগ্রিক উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়ার যে কৌশল নেওয়া হয়েছে, তা ইতিবাচক। তবে বাজেটে এসব লক্ষ্য পূরণে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হয়নি।
বাজেটে কিছু ইতিবাচক দিকও তুলে ধরে সিপিডি। যেমন, কর অব্যাহতি, নির্দিষ্ট খাতে বরাদ্দ ও প্রণোদনা, এবং ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে উচ্চহারে কর আরোপের উদ্যোগ। সিপিডি আশা প্রকাশ করে, কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতায় দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা অর্থ উপদেষ্টা প্রস্তাবিত বাজেটের বিতর্কিত বিষয়গুলো পর্যালোচনা ও প্রয়োজনীয় সংশোধন করবেন।
এসময় প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করে সিপিডি। এতে বলা হয়, বাজেটের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা, প্রবৃদ্ধি, মেগা প্রকল্প, শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ও কর কাঠামো; সব দিক থেকেই বাস্তবতার চেয়ে উচ্চাশাপূর্ণ।
অবাস্তব প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা
২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হলেও সদ্যসমাপ্ত বছরে তা হয়েছে ৪ শতাংশ (বিবিএস তথ্য অনুযায়ী)। বিনিয়োগ-অবানুকূল পরিবেশে বেসরকারি বিনিয়োগে ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন অবাস্তব বলেও মনে করে সিপিডি।
মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামানো কঠিন
বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। অথচ মে মাস পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ১ শতাংশ। সিপিডির মতে, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট, সরকারের ব্যয়ের চাপ এবং আমদানি জটিলতা থাকলে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব নয়।
মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি
নতুন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ২০টি মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট এডিপির ১৯ শতাংশ। অথচ কোনো প্রকল্পই চলতি অর্থবছরে শেষ হবে না। অনেক প্রকল্পের বয়স ১০ বছরের বেশি এবং ৪৭ দশমিক ৮ শতাংশ প্রকল্প একাধিকবার সংশোধিত হয়েছে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ঘাটতি
শিক্ষা খাতে জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দ কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ, যা এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় সর্বনিম্ন। স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ কমানো হয়েছে ১৩ শতাংশ। সিপিডি মনে করে, মানব উন্নয়নে এ দুটি খাতে আরো বেশি বরাদ্দ প্রয়োজন।
কর কাঠামোতে বৈষম্য
নতুন আয়কর কাঠামোয় মধ্যবিত্তের ওপর করের চাপ বেড়েছে। যেমন: বার্ষিক আয় ৬ লাখ টাকায় কর বেড়েছে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ; ১০ লাখ টাকায় কর বেড়েছে ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ; ১৫ লাখ টাকায় কর বেড়েছে ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ৩০ লাখ টাকায় কর বেড়েছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ।
সিপিডি বলছে, এটি কর ন্যায়ের পরিপন্থি এবং আয় বৈষম্যকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
অন্যান্য কর ও বিতর্কিত সিদ্ধান্ত
তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির কর ব্যবধান ৭ দশমিক ৫ শতাংশ রাখা হয়েছে, যা বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে পারে। তবে ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ ও বাড়িভাড়া খাতে উৎসে কর বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের ব্যয় বাড়াবে। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখাকে জুলাই আন্দোলনের ‘চেতনার পরিপন্থি’ বলে মন্তব্য করেছে সিপিডি।
বাজেট বাস্তবায়নে কাঠামোগত দুর্বলতা
সিপিডির পর্যবেক্ষণে, বাজেটের আয়-ব্যয়ের ফারাক, কর আদায়ের দুর্বলতা, বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা এবং মানব উন্নয়ন খাতে অপ্রতুল বরাদ্দ মিলিয়ে বাজেট বাস্তবায়নে বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েছে।
এনবিআর সংস্কারের বাজেট হওয়ার কথা রাখা হয়নি
প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট যা দেওয়া হয়েছে সেখানে এনবিআরের সংস্কারের বাজেট হওয়ার কথা ছিল কিন্তু সেটি হয়নি বলে জানিয়েছেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাজেটে যা দেওয়া হয়েছে সেখানে এনবিআরের সংস্কারের বাজেট হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেটি তো হয়নি। করমুক্ত আয়ের যে সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে তা আগামী অর্থবছরে যোগ হবে, তখন মূল্যস্ফীতি আরো বৃদ্ধি পাবে।’
তিনি বলেন, ‘এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনকে মাথায় রেখে কিছুটা সংস্কার করার কথা চিন্তা করা হয়েছে। টার্ন ওভার ট্যাক্স একটি চাপ তৈরি করবে। নতুন নতুন জায়গায় রেভ্যুনিউ কালেক্ট করতে হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের ১১০ পণ্যে শুল্ক সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১১০টি মার্কিন পণ্যের আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি ৬৫টি পণ্যে আমদানি শুল্ক হ্রাস, ৯টি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার এবং ৪৪২টি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক হ্রাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ধরনের সুযোগ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী অন্যান্য দেশকেও দিতে হবে। তা করতে না পারলে বৈষম্য হবে। আবার সবাইকে সুযোগ দিলে বিশাল রাজস্ব হারাবে সরকার। রাজস্ব আদায়ে দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। এ জন্য অনেক ভালোভাবে বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
কেকে/ এমএস