পবিত্র ঈদুল আজহার চার দিন আগে থেকে রাজধানীতে পশুর হাট বসে। ঈদের দিনও কুরবানির পশুর কেনাবেচা হয়। সব মিলিয়ে পাঁচ দিন হাটগুলো জমজমাট থাকে। আগামী ৭ জুন দেশে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। সে হিসেবে কুরবানির হাট শুরু হওয়ার কথা ৩ জুন। তবে এখনো কিছু সংখ্যক হাটে ইজারাদার নিয়োগ চূড়ান্ত করতে না পারাসহ নানা অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে। ঢাকার দুই সিটিতে ইজারাদার নিয়োগ নিয়ে রয়েছে বিতর্ক ও সমালোচনা।
এদিকে ইজারা কার্যক্রম চূড়ান্ত করতে না পারায় হাট বসানোর প্রস্তুতি নিতে দেরি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন পশু বিক্রেতারা। এছাড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে তাদের।
তবে পশুর হাটকেন্দ্রিক আমাদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে বলে জানিয়েছে ডিএমপি। ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, যে কোনো ধরনের নাশকতা এড়াতে ও হাটের ক্রেতা-বিক্রেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইজারাদারদের সঙ্গে বৈঠক করেছে ডিএমপি। গণ্যমান্য ব্যক্তি, ডিএমপির অপরাধ ও গোয়েন্দা বিভাগের পুলিশের উপ-কমিশনারদের (ডিসি) সঙ্গে আলাদা বৈঠক করে নিরাপত্তা পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। বিগত বছরের মতো এবারো পশুর হাটগুলোতে শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিতভাবে কাজ করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ, মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় বসছে ১৯টি অস্থায়ী পশুর হাট। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় ১০টি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় বসবে ৯টি হাট। এখন পর্যন্ত দুই সিটিতে ১৭টি হাটের ইজারা নিশ্চিত করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। হাট ঘুরে দরদাম যাচাই করছেন ক্রেতারা।
ঢাকা দক্ষিণে আটটি এবং ঢাকা উত্তরে ৯টি হাট ইজারা দিতে পেরেছে সিটি করপোরেশন। ডিএনসিসির ৯টির মধ্যে আটটি এবং ডিএসসিসির আটটি হাটেরই ইজারাদার বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা।
ইজারা কার্যক্রম চূড়ান্ত করতে না পারায় হাটের প্রস্তুতি তথা বসানো নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। আগে ভাগে হাটে গরু নিয়ে এসে বিপাকে পড়েছেন শত শত বেপারি। এছাড়া গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতেও চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে বিভিন্ন জেলা থেকে হাটে গরু ও ছাগল নিয়ে আসা বিক্রেতাদের।
বেপারিদের অভিযোগ, হাটে ইজারাদার কিংবা ব্যবস্থাপনায় কেউ না থাকায় পানি, শৌচাগার থেকে শুরু করে তাঁবু বা খুঁটি এসব কিছুর ব্যবস্থা করা হয়নি। অথচ, একটি পক্ষ ভালো জায়গা দেওয়ার নামে তাদেরকে হাটে আসতে বলেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশুর হাটে ব্যবস্থাপনা রাখাই এবার কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে। কারণ বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব থাকে।
তারা বলছেন, কুরবানির পশুর হাট ঢাকা সিটির বাইরে হলেই ভালো হয়। তাহলে বেশির ভাগ অব্যবস্থাপনা আপনাআপনি দূর হবে। অব্যবস্থাপনা বলতে যত্রযত্র গরুর গাড়ি রাখা এবং গরু রাখা, ট্রান্সপোর্টেশনে সরকারের নির্দেশনা না মানার কারণে যানজট তৈরি, প্রতিদিনের বর্জ্য প্রতিদিন না সরানোর কারণে দুর্গন্ধসহ পকেটমারের মতো কিছু সমস্যা আছে। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো জরুরি।
ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এবার আফতাবনগর ও মেরাদিয়াসহ মোট ১১টি স্থানে অস্থায়ী হাটের দরপত্র আহ্বান করেছিল ডিএসসিসি। পরে আইনগত জটিলতা থাকায় আফতাবনগর ও মেরাদিয়া হাটের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।
পরে বাতিল করা হয় শ্যামপুর কদমতলী পশুর হাটও। তাই অস্থায়ী হাটের সংখ্যা দাঁড়ায় আটটিতে। সাদেক হোসেন খোকা মাঠের দক্ষিণ পাশের খালি জায়গা, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের পাশের খালি জায়গায় দুটি হাটের বিষয়ে দরপত্র আহ্বান করা হলেও শুরুতে সরকারি মূল্যের চেয়ে কম পায়। কিন্তু বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের শপথকে কেন্দ্র করে নগর ভবন তালাবদ্ধ থাকায় কার্যক্রম আটকে যায়। আন্দোলনের কারণে সর্বোচ্চ দর পাওয়া হাটগুলোর ইজারাদারকে কার্যাদেশ ও বাকি হাটগুলোর পুনঃদরপত্র আহ্বান করতে পারছে না ডিএসসিসি।
ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা হাছিবা খান বলেন, ‘সময় কম হলেও প্রস্তুতি নিয়ে সমস্যা হবে না আশা করি। আমরা ছয়টি পশুর হাটের ইজারা চূড়ান্ত করতে পেরেছি।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ বছর একটি স্থায়ী (গাবতলী) হাটের পাশাপাশি ১০টি অস্থায়ী হাট বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএনসিসি।
সংস্থাটির সম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, এ বছর একটি স্থায়ী (গাবতলী) হাটের পাশাপাশি ১০টি অস্থায়ী হাট বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
হাটগুলোর ইজারাদার নিয়োগে দেরি হওয়ায় হাট বসানোর প্রস্তুতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন দরপত্র দেওয়া ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, হাটের প্রস্তুতির জন্য কমপক্ষে দুই সপ্তাহ সময়ের প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রচারণার বিষয় রয়েছে। সারা দেশের গবাদিপশুর ব্যবসায়ী কিংবা পাইকারদেরও জানানোর বিষয় রয়েছে।
ঢাকা উত্তরে গরুর ৮টি হাটের ইজারাদারই বিএনপি নেতা : পবিত্র ঈদুল আজহায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) ৯টি অস্থায়ী পশুর হাটে ইজারাদার নিয়োগপ্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে আটটি হাটেরই ইজারাদার বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা।
রাজধানীর খিলক্ষেত থানাধীন মস্তুল চেকপোস্ট-সংলগ্ন খালি জায়গায় হাটের ইজারা পেয়েছে সুরমি এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মজিবুল্লা খন্দকার। তবে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আকতার হোসাইন নেপথ্যে থেকে হাট পরিচালনা করছেন বলে জানা গেছে।
তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট-সংলগ্ন খালি জায়গায় হাটের ইজারা পেয়েছে জায়ান এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। মনিরুজ্জামান জানান, তিনি তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা যুবদলের সদস্য সচিব।
ভাটারা সুতিভোলা খালসংলগ্ন খালি জায়গায় হাটের জন্য সরকারি দর দিয়েই এ হাটের ইজারা পেয়েছে তামিম এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক ঢাকা উত্তর সিটির ৪০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম।
এদিকে উত্তরা দিয়াবাড়ি হাটের ইজারা পেয়েছেন এস এম খোকন। তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক। তার প্রতিষ্ঠানের নাম এস এম ব্রাদার্স।
মিরপুর-৬ নম্বর সেকশনে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গায় হাটের ইজারা পেয়েছে সোহাগ এন্টারপ্রাইজ। এর মালিক রতন মিয়া একজন ব্যবসায়ী। হাট ইজারায় রতন মিয়ার সঙ্গে স্থানীয় বিএনপি নেতারা সহযোগিতা করছেন ও যুক্ত বলে জানা গেছে।
ঢাকা উত্তর সিটির মোহাম্মদপুর বছিলা হাটের ইজারা পেয়েছে আহাদ এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক জামাল মৃধা। তিনি মোহাম্মদপুর থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক।
উত্তরা-১০ নম্বর সেক্টর রানাভোলা অ্যাভিনিউ-সংলগ্ন খালি জায়গার হাটের ইজারা পেয়েছে আতিকুর রহমান অ্যান্ড কোং। প্রতিষ্ঠানটির মালিক আতিকুর রহমান মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
উত্তরখানের কাঁচকুড়া বাজার-সংলগ্ন রহমান নগর হাটের ইজারা পেয়েছে আরহাম এন্টারপ্রাইজ। এর মালিক আরশাদুল কবির। আরশাদুল কবির জানান, হাট পরিচালনায় সার্বিক সহযোগিতায় আছেন তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি শাহ মিরাজ।
এদিকে খিলক্ষেত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচের খালি জায়গার হাট ইজারা পেয়েছে ক্ল্যাসিক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। এর মালিক মো. হাবিবুর রহমান। তিনি কাফরুল থানা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
বিএনপি নেতাদের কব্জায় দক্ষিণ সিটির পশুর হাট : বিগত বছরগুলোতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কুরবানির পশুর হাটগুলো ছিল আওয়ামী লীগের নেতাদের কবজায়। এবার সব হাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন বিএনপির নেতারা। এর মধ্যে নিয়ম ভেঙে সরকারি দরের চেয়ে অর্ধেক দামে বিএনপির নেতারা দুটি হাটের ইজারা বাগিয়ে নিয়েছেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আটটি হাটের সব কটির ইজারা বিএনপির নেতারা পেয়েছেন। তবে ইজারা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপির পদস্থ নেতাদের মাধ্যমে দরপত্র জমা না দিয়ে কিছু ক্ষেত্রে বিএনপি-সমর্থিত ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে দরপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। পরে স্থানীয় বিএনপি ও দলটির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা মিলেমিশে হাট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
যেমন উত্তর শাহজাহানপুর মৈত্রী সংঘ ক্লাবের খালি জায়গার ইজারা কাগজে-কলমে বিএনপি-সমর্থিত ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান পেয়েছেন। তবে এর নেপথ্যে রয়েছেন শাহজাহানপুর থানা বিএনপি ও দলটির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারা। গত বছর এ হাটের ইজারা পেয়েছিলেন সেখানকার আওয়ামী লীগের সাবেক কাউন্সিলর হামিদুল হক। এর আগে সাত বছর ধরে শাহজাহানপুর থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুল লতিফের নিয়ন্ত্রণে ছিল এ হাট।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, সরকারি মূল্যের চেয়ে কম দর পাওয়া দুটি হাটের অনুমোদন পেতে তারা আইন অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছেন। মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে তাদের কার্যাদেশ দেওয়া হবে।
কেকে/এআর