ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের। এর মধ্য দিয়ে অবসান হয় ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার। যার অগ্রাধিকারের মধ্যে ছিল ফ্যাসিস্টদের বিচার, সংস্কার কাজ বাস্তবায়ন করা এবং যৌক্তিক সময়ের মধ্যে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মধ্যে দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর।
কিন্তু অভ্যুত্থানের নয় মাস পেরিয়ে গেলেও এই তিন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং এর বাইরে নানা ইস্যুতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছে সরকার। এদিকে যত দিন যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলার অবনতিসহ নানা বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে রাষ্ট্রে। সরকারের সঙ্গে বাড়ছে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব। নতুন বন্দোবস্তের কথা বলে আসা সরকারের অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। এমনকি আর্থিকসহ নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন খোদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অনেক নেতা। কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের দেখা না পেয়ে হতাশা বাড়ছে মানুষের মধ্যে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার তার মূল অগ্রাধিকারের জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে। সংস্কার নিয়ে কালক্ষেপণ হচ্ছে। নির্বাচন নিয়েও নেই কোনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ। ফলে মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। এদিকে করিডর, চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি কোম্পানির লিজ দেওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্কে। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সরকারের এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের সুচিকিৎসা পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি, পুনর্বাসনও নেই। এসব কারণে দেশ এক ধরনের অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
মাত্র দশ মাসের মাথায় নানামুখী অস্থিরতায় কিছুটা টালমাটাল অবস্থায় সরকার। গত শনিবার বিএনপির বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, সরকার জনগণের ভাষা-আশা-আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তেই থাকবে। তিনি আরো বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আবারো আহ্বান জানিয়ে বলবো, পরিস্থিতির অযথা ঘোলাটে না করে জাতীয় নির্বাচনের সুস্পষ্ট তারিখ ঘোষণা করুন। জনগণের ভোটে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকার প্রতিষ্ঠা না করা গেলে পতিত স্বৈরাচারকে মোকাবিলা করা সহজ হবে না।
তিনি বলেন, লোভ-লাভের প্রলোভন থেকে মুক্ত থেকে অন্তবর্তীকালীন সরকার জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে বাংলাদেশে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দায়িত্ব পালন করবে এ আশা করছি। তিনি আরো বলেন, বিএনপিসহ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশ্য তাদের পরিকল্পনা-কর্মপরিকল্পনা নিয়ে একটি রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে আসছে। সব কিছু বিবেচনা করলে আমরা দেখতে পাই সরকার কিন্তু সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, সরকারই বরং জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণাকে সুকৌশলে ‘অল্প সংস্কার-বেশি সংস্কার’ এরকম একটি অভিনব শর্তের বেড়াজালে বলা যায় আটকে দিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা প্রতিদিন দেখছি কোনো না কোনো দাবি নিয়ে মানুষ রাস্তায় নামছে। মাত্র ১০ মাসের মাথায় সরকারের ভেতরে এবং বাইরে কিন্তু এক ধরনের অস্থিরতা দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। সরকার জনগণের ভাষা-আশা-আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তেই থাকবে। তারেক রহমান বলেন, আমরা মনে করি অস্থিরতা এভাবে বাড়তে থাকলে এ সরকারের পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। সুতরাং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তাদের সক্ষমতা সম্পর্কে আরো সতর্ক থাকার আহ্বান জানাই।
এদিকে দেশকে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন সরকার এমনভাবে চলছে যেন তারা নির্বাচিত সরকার। সরকার বারবার বলছে, সংস্কার করে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে সব হবে। কিন্তু সেই ঐকমত্যটা কোথায় হচ্ছে, সেটিও তারা বলে না। এটা একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, তাদের দায়িত্ব ছিল একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা তুলে দেওয়া। বাংলাদেশ একটা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পড়ে আছে, দেশ কোথায় যাচ্ছে কেউ জানে না।
তিনি বলেন, জাতি একটা শঙ্কার মধ্যে আছে। নির্বাচন না দিয়ে অন্যদিকে ধাবিত হচ্ছে। করিডর ইস্যু, বিনিয়োগ সম্মেলন হচ্ছে, বন্দর দিয়ে দিচ্ছে। তাদের এসব ক্ষমতা কে দিয়েছে? তিনি আরো বলেন, দক্ষিণের মেয়রের যে ইস্যু, কোর্টের যে অর্ডার সেই অনুযায়ী বাস্তবায়ন হতে হবে। তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বিভিন্ন ধরনের লোককে প্রতিনিয়ত দায়িত্ব নিচ্ছে। এরা কারা? বন্দরে বাইরের অপারেটর আনার মতো সিদ্ধান্ত জনসমর্থন নিয়ে করা উচিত বলে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এর সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। এটি শুধু বিনিয়োগের ব্যাপার না। সরকার নির্বাচন বাদে বাকি সব কিছু করছে। সব কিছুর দায়িত্ব তাদের কে দিল?
দেশে এখন বহুমাত্রিক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। খোলা কাগজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, সরকারের প্রধান যে অ্যাজেন্ডা বিচারকে ত্বরান্বিত করা, এটাতে কোনো গতি দেখছি না। এ ছাড়া সংস্কারের বিষয়টি, এটা আসলে ১৫ দিন থেকে এক মাসের কাজ। এটাতেও গতি নেই। ঘটনার ঘনঘটা থেকে মনে হচ্ছে সরকারে অগ্রাধিকারে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন নেই। তিনি আরো বলেন, মানবিক করিডরের নামে এক ধরনের তৎপরতা, বিদেশি কোম্পানির কাছে চট্টগ্রাম বন্দর লিজ দেওয়া, স্টার লিংককে ডেকে আনা অনেক কাজ দেখছি, যেগুলোর মধ্যে আন্তঃযোগসূত্র দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সরকার কাজের চেয়ে অকাজ বেশি করছে। যেগুলো সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে না, সেগুলোতে তাদের নজরটা বেশি।
সরকারের মধ্যেও পরস্পরবিরোধী অবস্থান দেখা যাচ্ছে উল্লেখ করে সাইফুল হক বলেন, তাদের এক একজন এক এক কথা বলছেন। সরকারের মধ্যে বড় সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত দূরত্ব বাড়ছে। ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হচ্ছে, সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
তিনি বলেন, অনেক দুর্নীতির কাহিনি বেরিয়ে আসছে। এগুলোর সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট নানা ব্যক্তি দলের নাম উঠে আসছে। এটা নতুন উদ্বেগের বিষয়। সবমিলে দেখছি দেশটা একটা অস্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। একটা আধা-নৈরাজ্যিক অবস্থা চলছে। সরকার যে বিনিয়োগের কথা বলেছে, বিনিয়োগ সম্মেলনে, বাস্ততে এ পর্যন্ত সেরকম বিনিয়োগ আসেনি। আসার সম্ভাবনাও কম। বিনিয়োগকারীরা একটা স্থিতিশীল সরকার দেখতে চান। তারা অপেক্ষা করছেন একটি নির্বাচিত সরকারের জন্য।
তিনি আরো বলেন, নানা আন্দোলন, দাবিদাওয়া এসব দেখে মনে হচ্ছে এটা সরকার এবং সরকারের সমর্থিত দলের মধ্যকার বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই মূলত হচ্ছে। যেটা সরকারের নিরপেক্ষতাকে বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ফেলছে। মাত্র দশ মাসের মাথায় মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা হতাশায় পর্যবসিত হচ্ছে। যদিও ক্ষমতায় আসার পর পর সরকার একটি ভালো বার্তা দিয়েছিল, ভারতের সঙ্গে শক্ত অবস্থানের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এটার বিপরীতে দেখা যাচ্ছে করিডর-বন্দর নানা ধরনের তৎপরতায় মনে হচ্ছে অন্য কোনো পরাশক্তি রাজনীতির অংশ বাংলাদেশ হয়ে যাচ্ছে কিনা। এসব কারণের সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকারের উচিৎ হবে এ নিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করা।
সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সংশয় জামায়াতের
নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে সৈয়দ আমির আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেছেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আগামী নির্বাচনও একেবারে সঠিক সুষ্ঠু হবে, এমন পরিস্থিতি এখনো লক্ষ করা যাচ্ছে না। কারণ কোনো কোনো নির্বাচনি এলাকায় ইতোমধ্যেই নানা সমস্যা দেখা যাচ্ছে। কিছুদিন আগে পাবনায় আটঘরিয়া এলাকায় জামায়াতের অফিসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। কিছু মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এখনো নির্বাচনের তারিখই হয়নি, জায়গা দখলের প্রতিযোগিতা হচ্ছে।’ নির্বাচন নিয়ে সরকারের পদক্ষেপের কিছুটা ‘ঘাটতি’ আছে বলেও মনে করে তাহের। তিনি বলেন, ‘জেনে, অথবা না জেনে, কিছু কিছু পদক্ষেপ এমন আছে, যেখানে নিরপেক্ষতার অথবা দক্ষতার অভাব আছে।’
কেকে/ এমএস