দেশে বেড়ে চলছে অপরাধপ্রবণতা। সামান্য ঘটনায়ই সহিংস হয়ে উঠছে মানুষ। এর জেরে নিকটজনকে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও ঘটছে অহরহ। চুরি করতে গিয়ে খালাকে হত্যা, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজের মেয়েকে হত্যার মতো নৃশংসতায় জড়াচ্ছে মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিনে দিনে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। এর ফলে মানুষের মধ্যে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। বিশেষ করে ডিজিটাল মাধ্যমের অবাধ ব্যবহার তরুণদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। যার প্রতিফল ঘটছে সমাজে।
গত শনিবার কুড়িগ্রামের সদর উপজেলায় একটি ভুট্টাখেত থেকে জান্নাতি খাতুন (১৫) নামের এক স্কুলছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ওই কিশোরীকে হত্যা করে তারই বাবা-মা। পুলিশ জানায়, মো. জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে তার প্রতিবেশী মজিবর রহমানের ৩২ বিঘা জমি নিয়ে বিরোধ চলছিল। জাহিদুল ইসলাম তার প্রতিপক্ষ মজিবরদের ফাঁসানোর উদ্দেশ্যে শনিবার গভীর রাতে তার স্ত্রী ও ভাইয়ের স্ত্রীর সহযোগিতায় নিজের নবম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে জান্নাতি খাতুনকে হত্যা করেন। এর পর লাশ একটি ভুট্টাখেতে ফেলে রাখেন এবং খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে দেন। হত্যার ঘটনায় নিহতের চাচা মো. খলিল হক বাদী হয়ে কুড়িগ্রাম থানায় একটি অভিযোগ করেন। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজ কন্যাকে হত্যা করে বাবা-মা। এ ঘটনায় নিহতের বাবা মো. জাহিদুল ইসলাম (৪৫), মা মোর্শেদা বেগম (৩৮) ও চাচি শাহিনুর বেগমকে (৪৫) গ্রেফতার করা হয়। পরে আসামিরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
এদিকে গত শুক্রবার রাজধানীর শেওয়ড়াপাড়ায় টাকা চুরি করতে দেখে ফেলায় দুই খালাকে খুন করে ১৪ বছর বয়সি এক কিশোর। এ ছাড়া গত সোমবার দুপুরে নটর ডেম কলেজের একটি ভবন থেকে পড়ে ধ্রুবব্রত দাস নামের এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। তবে নিহত শিক্ষর্থীর মায়ের অভিযোগ, তার ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাজধানীর আরামবাগে মো. মোমিন (২০) নামের এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। একই দিন গুলশানের লেকপাড় এলাকায় শরিফুল আলম করিম (৩৫) নামের এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। এদিকে গতকাল লক্ষ্মীপুরে একটি মাদ্রাসা থেকে সানিম হোসাইন নামের এক শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তার পরিবারের দাবি শিক্ষকের মারধরে তার মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার অদূরে সাভারে নিজ বাবাকে কুপিয়ে হত্যা করেন এক তরুণী। বাবার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনেন তিনি।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, ডিজিটাল মাধ্যমের অবাধ প্রবাহের যুগে মানুষের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আসক্তি তরুণদের মধ্যে ভীষণ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভেঙে যাচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধ। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যেও। এর ফলে অপরাধী নন, এমন মানুষের মধ্যেও বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। তুচ্ছ ঘটনায়ও তারা হয়ে উঠছেন নৃশংস।
শেওড়াপাড়ায় জোড়া খুনের ঘটনায় পুলিশ জানিয়েছে, সাইকেল কিনতে খালার বাসায় এসেছিল ভাগনে (১৪)। খালার অগোচরে মানিব্যাগ থেকে ৩০০০ টাকা বের করার সময় ধরা পড়ে যায় সে। মাকে বলে দিতে চাওয়ায় টেবিলে থাকা ছুরি দিয়ে প্রথমে বড় খালাকে, পরে তার চিৎকারে ছুটে আসা ছোট খালাকে ছুরিকাঘাত করে এবং শিলপাটা দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে। পরে খালাদের জানাজায়ও অংশ নেয়। পুলিশের তদন্ত কাজেও সে সহযোগিতা করে এবং নানাভাবে আড়িপাতার চেষ্টা করে।
পরে ডিবি পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ ও পারিপার্শ্বিক তদন্তের ভিত্তিতে তাকে শনাক্তের পর গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে দুই খালাকে খুন করেছে বলে স্বীকার করে সে কিশোর। ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ডিবি-দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, মামলার বাদী নুসরাত জাহান ভিকটিম মরিয়ম বেগমের মেয়ে ও অপর ভিকটিম সুফিয়া বেগমের ভাগনি। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, গত শুক্রবার রাত ১২টায় গ্রেফতার ওই শিশু যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ার বাসা থেকে প্রাইভেট পড়ার জন্য পাঞ্জাবি পরে বের হয়। কিন্তু সে বাসা থেকে বের হয়ে প্রাইভেট পড়তে না গিয়ে সাইকেল কেনার উদ্দেশ্যে তার বড় খালার (মরিয়ম বেগম) শেওড়াপাড়ার বাসায় যায়।
সিএনজির ভেতরেই সে পাঞ্জাবি চেঞ্জ করে নীল রঙের টিশার্ট পরিধান করে। তারপর শেওড়াপাড়া মেট্রোরেলের নিচে নেমে একটি লাল রঙের ক্যাপ মাথায় ও মুখে মাস্ক পরে আনুমানিক ১২টা ৫০ মিনিটে বড় খালার বাসায় পৌঁছায়। গেটে তালা না থাকায় সে গেট খুলে দ্বিতীয় তলায় তার বড় খালার রুমে নক করলে তিনি চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেন।
নিখোঁজ শিশুর বস্তাবন্দি লাশ মিলল ময়লার স্তূপে, জখমের চিহ্ন
রাজধানীর তেজকুনিপাড়া এলাকায় নিখোঁজের একদিন পর পাঁচ বছর বয়সি এক শিশুর লাশ মিলেছে ময়লার স্তূপে। গতকাল লাশটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে পাঠিয়েছে পুলিশ। রোজা মনি নামের ওই শিশুটি গত সোমবার বিকাল থেকে নিখোঁজ ছিল। স্বজন ও প্রতিবেশীরা বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে তার হদিস না পেয়ে মাইকিংও করে। তেজগাঁও থানার এসআই আবদুল কাদের বলেন, ‘শিশুটির শরীরে ফোসকার মতো ক্ষত রয়েছে। ধারণা করা যায়, তার শরীরে গরম পানি বা এ ধরনের কোনো কিছু ঢেলে দেওয়া হয়েছে। আমরা লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠিয়েছি।’
মাদ্রাসাছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ, শিক্ষক আটক
লক্ষ্মীপুরে আল-মুঈন ইসলামী একাডেমি থেকে হেফজ বিভাগের ছাত্র সানিম হোসাইনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পরিবারের দাবি শিক্ষক মাহমুদুর রহমানের মারধরে সে মারা গেছে। ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রভাবিত করতে সানিম টয়লেটে ঢুকে আত্মহত্যা করেছে বলে শিক্ষকরা প্রচার করেছে। পরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শিক্ষক মাহমুদুর রহমানকে আটক করে পুলিশ। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে পৌর শহরের উত্তর তেমুহনী এলাকায় মাদ্রাসা থেকে মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে পুলিশ। এর আগে দুপুরে সানিমের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। নিহত সানিম রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের কুচিয়ামারা গ্রামের মুদি ব্যবসায়ী হুমায়ুন মাতব্বরের ছেলে।
পরিবারের এক সদস্য বলেন, গতকাল সকালে সানিমকে শিক্ষক মাহমুদুর রহমান মারধর করেন, দুপুরে খবর পাই সানিম নাকি টয়লেটে ঢুকে গলায় ফাঁস দিয়েছে। মাদ্রাসায় এসে সেই হুজুরে কথা জিজ্ঞেস করতে সবাই বলেছে তাকে আটকে রাখা হয়েছে। সানিমের লাশ আমরা টয়লেটে পাইনি। তার লাশ মাদ্রাসার নিচতলার একটি কক্ষে বিছানায় পেয়েছি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) রেজাউল হক বলেন, মাদ্রাসাছাত্র আত্মহত্যার খবর পেয়ে আমরা এসেছি। তার গলায় ও শরীরের বিভিন্ন অংশে কালো দাগ রয়েছে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একজনকে আটক করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর আসল কারণ জানা যাবে।
আরামবাগে ধারালো অস্ত্র দিয়ে যুবককে হত্যা
রাজধানীর মতিঝিলের আরামবাগে মো. মোমিন নামের এক যুবককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে দুর্বৃত্তরা হত্যা করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। গতকাল সকাল পৌনে ১০টার দিকে আরামবাগ টিঅ্যান্ডটি কলেজের সামনে এ ঘটনা ঘটে। মতিঝিল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জুলহাস উদ্দিন বলেন, মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলেজের সামনে মোমিন নামের ওই যুবকের গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে দুর্বৃত্তরা। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে বেলা পৌনে ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান পথচারীরা। পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ব্যবসায়ীকে গুলি করে পালাল মুখোশধারীরা
রাজধানীর গুলশান লেকপাড় এলাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে শরিফুল আলম করিম (৩৫) নামে এক ব্যবসায়ী আহত হয়েছেন। গতকাল দুপুর সোয়া ২টার দিকে গুলশান-১ লেকপাড়ে এ ঘটনা ঘটে। আহত অবস্থায় স্বজনরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন।
আহত শরিফুল আলম করিম নিজেই জানান, তার বাসা দক্ষিণখান গাওয়াইল এলাকায়। মহাখালী এলাকায় তার নার্সারি ব্যবসা রয়েছে। দুপুরে বাসা থেকে বাসে করে মহাখালী যাচ্ছিলেন। পথে জ্যাম দেখে গুলশান এলাকায় বাস থেকে নেমে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ সময় তিন থেকে চারজন মুখোশ পরা যুবক তাকে ডাক দিয়ে বলেন, এদিকে আসেন, কথা আছে। তিনি যেতে না চাইলে জোর করে ধরে নিয়ে যান। তখন তাদের সঙ্গে কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে তাদের কাছে থাকা পিস্তল দিয়ে করিমের পেটের বাম পাশে গুলি করে পালিয়ে যান।
কেকে/এআর