ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার না হওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন আজ জারি করা হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠকে গত শনিবার রাতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিচারের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে।
তবে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে, সেটি দেশের রাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হলে দলটি চরম বিপর্যয়ে পড়বে। রাজনীতিতে তারা আবার ফিরতে পারবে কি না এটা অনেকটাই অনিশ্চিত। আবার কেউ বলছেন, জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ীদের বিচার হতে হবে। কিন্তু ‘যে প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধের দাবিটি সামনে এনে সরকার অগ্রসর হয়েছে’ তা ভবিষ্যতে প্রতিপক্ষ দমনে রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠতে পারে। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দিকে গড়ালে এবং সেই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা শুরু করলে সংঘাত-সংঘর্ষের রাজনীতিই আবার ফিরে আসতে পারে। আর সংঘর্ষ, সহিংস রাজনীতি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে আরো অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
এদিকে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার সরকারি আদেশ হাতে পাওয়ার পর দলটির নিবন্ধন বাতিলে করণীয় ঠিক করার কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আদালত কর্তৃক নিষিদ্ধ হলে বা চূড়ান্তভাবে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলে আওয়ামী লীগের পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকবে না।
এ বিষয়ে গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন বলেন, আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ইসি এখন সরকারি গেজেট প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। আজ সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। ফলে নির্বাচনি আইন অনুযায়ী দলটি নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা হারাবে। দলটির নিবন্ধন বাতিল হবে ১৯৭২ সালের ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)’-এর ৯০এইচ (১) (বি) ধারার বিধান অনুযায়ী। একইসঙ্গে আরপিওর ৯০সি (১) (৩) ধারা অনুযায়ী সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে দলটিকে পুনরায় আর নিবন্ধন দেবে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের জন্য ইসির নিবন্ধন থাকা বাধ্যতামূলক।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক বিশ্ব এ নির্লজ্জ খুনি, গণতন্ত্রবিরোধী ও দুর্নীতিগ্রস্ত দলের পক্ষে কখনো কথা বলবে না বলে মনে করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গতকাল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া নিয়ে বাসসের করা এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব এসব কথা বলেন। প্রেস সচিব বলেন, গণতান্ত্রিক বিশ্বে এমন কোনো পক্ষ নেই, যারা নির্লজ্জ এ খুনি, গণতন্ত্রবিরোধী ও দুর্নীতিগ্রস্ত দলের পক্ষে কথা বলবে।
তিনি আরো বলেন, এ নিষেধাজ্ঞা জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজন ছিল।
নিষিদ্ধঘোষিত কোনো সংগঠন যদি জনগণের নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করে, তাহলে তাদের দমন করার সক্ষমতা পুলিশের রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা রেঞ্জের উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) রেজাউল করিম মল্লিক। তিনি বলেন, ‘আমার অধীনে এসপি-ওসিদের নির্দেশ দিচ্ছি, নিষিদ্ধঘোষিত কোনো সংগঠনের কর্মকাণ্ড আপনার এলাকায় চলবে না। বৈষ্যম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা দমন-পীড়ন করেছে, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, মামলার তদন্তে যারা দোষী, যারা দোসর হিসেবে পরিচিত, তাদের গ্রেফতার করতে হবে।’ গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচার ঢাকা রেঞ্জ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় রেঞ্জের অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, গণহত্যার বিচার সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গেই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ জড়িত এবং গতিপথ নির্ধারিত হবে। এটি আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদি কৃতকর্মের নৈতিক পরীক্ষা যা ন্যায়বিচার, মানবিকতা এবং গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার এক অগ্নিপরীক্ষা। তবে রাষ্ট্রকে অবশ্যই অভিযুক্ত হিসেবে আওয়ামী লীগের ন্যায় বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। গত শনিবার উত্তরার বাসভবনে অনুষ্ঠিত জেএসডির স্থায়ী কমিটির সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এদিকে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ‘সরকারের সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করেই আওয়ামী লীগ যথোচিতভাবে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে যাবে’। একইসঙ্গে সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ‘জনগণ দাঁতভাঙা জবাব দিবে’ বলেও ওই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে বর্তমানে নেতৃত্বশূন্য থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা চরম হতাশায় ভুগছে। তাদের অনেকেই এখন উদ্বেগ ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। সংবাদমাধ্যমে কথা বলার সময় তারা তাদের নামও প্রকাশ করতে চাননি। আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, ‘আমাদের দলের এখন দিশাহারা বিপর্যস্ত অবস্থা হয়ে গেছে। কারণ কেন্দ্র থেকে কার্যকর কোনো নির্দেশনা নাই। ফোন দিলেও কেউ ধরে না। হামলা-মামলা সব মিলিয়ে নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় নেতাকর্মীদের অনেকে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন।’
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের এখনকার যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, সেটার জন্য দলের সিনিয়র নেতাদের দায়ী করেছেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা। আওয়ামী লীগের এক কর্মী বলেন, ‘ক্ষমতা হারালে এমন অবস্থা যে হতে পারে, সেটা তো নেতাদের অজানা থাকার কথা না। তারাই তো এর জন্য দায়ী।’ তিনি আরো বলেন, ‘ক্রিম খাইলো নেতারা, কোটি কোটি টাকা বানাইলো তারা; আর তাদের পাপের শাস্তি ভোগ করতে হইতেছে আমাদের মতো তৃণমূলের নেতাকর্মীদের।’ হামলার ভয়ে নিজেরা গা ঢাকা দিলেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বেশিরভাগের পরিবার-পরিজন তাদের এলাকাতে রয়েছেন। তবে আয়-রোজগার না থাকায় সংসার চালাতে গিয়ে অনেকের স্ত্রী-সন্তানরা বিপাকে পড়েছেন।
তৃণমূলের এক নেতা বলেন, ‘ক্ষমতা হারানোর পর খালেদা জিয়া ছাড়েননি, এমনকী এরশাদের মতো স্বৈরাচারও পালায়নি। সেখানে নেত্রী কেন দেশ ছাড়ল, সেটাই আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারছি না। এ অবস্থায় বিচারের মুখোমুখি হতে হলেও এখন শেখ হাসিনার দেশে ফেরা উচিত।
নিষিদ্ধ ঘোষণার পর থেকে ‘রিফাইন্ড’ বা ‘পরিশুদ্ধ’ আওয়ামী লীগের ধারণা নিয়ে আলোচনা কিংবা নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার বিষয়গুলো এখন অবান্তর। সেইসঙ্গে আওয়ামী লীগের পরিশুদ্ধ অংশকে রাজনীতিতে ফেরানোর সম্ভাবনা নিয়ে যে শোরগোল চলছিল, বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা কতটা বাস্তবসম্মত, সেই প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।
গত সাড়ে পনেরো বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনায় মুখর ছিলেন নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। আওয়ামী লীগের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রভাব কেমন হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য কতটা ভুল স্বীকার করে এবং কীভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসে, তার ওপরই নির্ভর করবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদও বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের তো সব দলের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার সেটি করেনি। ‘আমার মনে হয় সিদ্ধান্তটিই সুনির্দিষ্ট হয়নি। আওয়ামী লীগের ভেতরেও অনেকে হত্যা, দুর্নীতি, লুটপাট সমর্থন করেননি’।
আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে নিষিদ্ধ থাকলে ধর্ম নিরপেক্ষতা, সংস্কৃতি ও নারীর অগ্রযাত্রার মতো বিষয়গুলো সংকটে পড়বে বলে অনেকে মনে করেন। আর এটি হলে উগ্রপন্থার আরো বিস্তৃতিলাভেরই আশঙ্কা তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন। ‘যে কোনো পরিস্থিতিতেই কোনো দল নিষেধাজ্ঞায় পড়লে সে আরো সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। আওয়ামী লীগকে বিনাশ করতে গিয়ে যদি ধর্মীয় উন্মাদনাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তার পরিণতি ভালো হবে না। দক্ষিণ এশিয়ায় এমন উদাহরণ কিন্তু আছে। এ উন্মাদনার বিরুদ্ধে বিএনপির পদক্ষেপ কেমন হয়, তার ওপরও দেশের রাজনৈতিক চিত্র অনেকটা নির্ভর করবে’।
তার মতে, এবার যা হয়েছে তা শুধু আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয় নয় বরং এর সঙ্গে একটি গোষ্ঠীর ক্ষমতার চর্চার যে বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে। সেটি দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য সুখকর হবে না বলে মনে করেন তিনি।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে দলটি নিষিদ্ধ হয়ে গেলে সমাজের ভেতরে থাকা সমর্থকদের কারণেই দীর্ঘমেয়াদে হলেও দলটি যখন ফিরে আসবে, তখনই সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠতে পারে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাব্বীর আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাই হলো দুই ধারায় মোটাদাগে যার একটির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আর অপরটির নেতৃত্বে বিএনপি। দল হিসেবে ৩৫-৪০ শতাংশ ভোট আওয়ামী লীগের। এখন তারা তাদের ভুল স্বীকার করে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে এগিয়ে আসার চেষ্টা যখন করবে, তখন রাজনীতিতে তার প্রভাব পড়বে।’
তার মতে, নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগকে ঠেলে দিতে চাইলে রাজনীতি আরো অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত হয়ে ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার শঙ্কা আছে।
তিনি আরো বলেন, ‘ফলে সহিংসতাই তখন রাজনীতির ভাষা হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ শক্তির জোরে টিকে থাকাটাই বড় হয়ে উঠতে পারে। আবার এমন পরিস্থিতির সুযোগে বিদেশীরাও আরো প্রভাবক হতে পারে, যা আরো বড় সংকট তৈরি করবে।’
কেকে/ এমএস