আপন দুই সহোদর কাজী জাহিদ হাসান (তারিফ) ও কাজী কবির। তাদের একজন সরকারি চাকরিজীবী, অপরজন ব্যবসায়ী। তবে এসব পরিচয়ের বাইরেও তাদের অন্যতম পরিচয় তারা একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক। অভিযোগ আছে নানা কূটকৌশলে রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সরকারি চাকরির আড়ালে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছেন তারিফ। এসব কাজের সহযোগী হয়ে কাজ করছেন তার বড় ভাই কবির। আর এভাবেই বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে দুই ভাই মিলে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে বাগিয়েছেন কোটি কোটি টাকার কাজ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাসিনা সরকারের সময়ে কাজী এন্টারপ্রাইজ, কবীর এন্টারপ্রাইজ, সুজন এন্টারপ্রাইজ, প্রভী ইন্টারন্যাশনাল ও ফারহানা এন্টারপ্রাইজ এ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালের ঠিকাদারি ও খাদ্য সরবরাহের কাজ হাতিয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে সরকারি কর্মকর্তা হয়েও কাজী তারিফ কীভাবে এসব ঠিকাদারি ব্যবসা পরিচালনা করতেন?
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাজী তারিফের বড় ভাই কাজী কবির একসময় আগারগাঁও এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। সে সময় দোলন নামে একজন ঠিকাদার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ করতেন। টেন্ডার ভাগাভাগি নিয়ে কবিরের সঙ্গে দোলনের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ২০০৩ সালে ঢাকার কাজী পাড়ায় দিন-দুপুরে খুন হন দোলন। এ মামলায় কাজী কবির ছিলেন ১ নম্বর আসামি, যে মামলাটি এখনো আদালতে বিচারাধীন।
এদিকে দোলন হত্যাকাণ্ডের পর ২০০৩ সাল থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নেন কাজী কবির ও কাজী তারিফ। সেই থেকে এখনো তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে হাসপাতালটি। তাদের বিরুদ্ধে গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের হত্যা মামলাসহ রাজধানীর বিভিন্ন থানায় রয়েছে একাধিক মামলা। এরমধ্যে কাজী কবিরের বিরুদ্ধে দোলন হত্যা মামলা ছাড়াও যাত্রাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা রয়েছে। অন্যদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মোহাম্মদপুরে আলোচিত এক হত্যা মামলার আসামি হয়েও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কাজী তারিফ। যদিও ৫ আগস্টের পর আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছেন কাজী কবির।
দোলনের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা অভিযোগ করেন, কবির একচেটিয়া ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে দোলনকে নির্মমভাবে খুন করেন। দুই দশকের বেশি সময় পার হলেও বিচার পায়নি নিহতের পরিবার। আর এ ঘটনার পর থেকেই অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কবিরÑতারিফের ভয়ে টেন্ডার জমা দিতেও সাহস করে না। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে হাসপাতালকে ঘিরেই তারা গড়ে তুলেছেন এক শক্তিশালী ঠিকাদারি সিন্ডিকেট। এর মাধ্যমে হাসপাতালের পিডব্লিউডির নানান প্রকল্পের কাজ নিজেদের কব্জায় রেখেছেন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, জুন-জুলাই বাজেটে নতুন কাজও বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন এ দুই ভাই। তাদের অভিযোগ, কাজী তারিফ রাজনৈতিক সুবিধাবাদী। একসময় আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় কাজ বাগিয়েছেন; এখন বিএনপির কোলে ওঠার চেষ্টা করছেন। একজন হত্যা মামলার আসামি হয়েও তিনি অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং সরকারি প্রকল্পে অংশ নিচ্ছেন। এতে স্থানীয়দের মাঝে তীব্র ক্ষোভ ও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়রা আরো জানান, কাজী তারিফ ইতোমধ্যে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এবং দেশের বাইরে অর্থ পাচারও করেছেন। তার ভাই কাজী কবির বর্তমানে আমেরিকা থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন।
জানতে চাইলে নিহত দোলনের ভাই শাহাবুদ্দিন আহামেদ শান্ত খোলা কাগজকে জানান, ‘আমার ভাইয়ের হত্যা মামলার ১ নম্বর আসামি কাজী কবির ২০০৩ সাল থেকে দেশে ছিল। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের পতনের সঙ্গে সে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে। সেখানে কাজী তারিফ তাকে ৮ কোটি টাকা দিয়ে বাড়ি কিনে দিয়েছে। কবির পালিয়ে গেলেও তার ভাই কাজী তারিফ এখনো দেশেই রয়েছে। তিনি সরকারি কর্মকর্তা হয়েও (স্বাস্থ্য অধিদফতরের এজি অফিসে কর্মরত) ঠিকাদারি কাজ করছেন।’
তিনি বলেন, ‘২০০৩ সালে আমার ভাইকে খুন করার পর থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কবির-তারিফদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। অস্ত্রের ভয়ে সেখানে আর কেউ কাজ করতে পারেনি। সরকার পরিবর্তন হলেও তাদের দাপটে ভাটা পড়েনি বরং বর্তমানে বিএনপির কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার আশীর্বাদে আগারগাঁও এলাকায় কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ করছে।’
শাহাবুদ্দিন আহামেদ শান্ত আরো বলেন, ‘কাজী কবির একজন চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়েও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছে। এছাড়া দোলন হত্যা মামলায় তাকে একবার থানা-পুলিশ আটক করলেও আওয়ামী লীগের দাপট দেখিয়ে ছাড়া পেয়ে গেছে। এখন আমরা আশা করি বর্তমান সরকার অথবা নতুন কোনো সরকার ক্ষমতায় এলে দোলন হত্যার ন্যায় বিচার পাব।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে কাজী তারিফের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে ‘হত্যা মামলা’ ও সিন্ডিকেট প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি ফোন কেটে দেন। এরপর আরো কয়েকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
কেকে/ এমএস