সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫,
২৮ আশ্বিন ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫
শিরোনাম: ১১ দিনে রেমিট্যান্স এলো প্রায় এক বিলিয়ন ডলার      জিয়া পরিবার জনগণের পরিবার : আমান উল্লাহ      রোমে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা      ২০০ তালেবান সৈন্যকে হত্যার দাবি পাকিস্তানের      বাতিল হওয়ার শঙ্কায় বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনার ভারত সফর      বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করে দেশে স্বৈরশাসন পাকাপোক্ত হয়েছিল      প্রেসক্লাবে শিক্ষকদের ছত্রভঙ্গে সাউন্ড গ্রেনেড-লাঠিচার্জ      
খোলা মত ও সম্পাদকীয়
শাপলা চত্বরের সেই রাত, বিচারহীনতার ঘোর অন্ধকারে শহিদদের আত্মা
সুদীপ্ত শামীম
প্রকাশ: সোমবার, ৫ মে, ২০২৫, ৬:৩৯ পিএম
ছবি : গণমাধ্যমকর্মী, কলামিস্ট ও সংগঠক সুদীপ্ত শামীম

ছবি : গণমাধ্যমকর্মী, কলামিস্ট ও সংগঠক সুদীপ্ত শামীম

২০১৩ সালের ৫ মে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিভীষিকাময়, নিষ্ঠুর এবং গভীরভাবে লজ্জাজনক রাত। হেফাজতে ইসলামের ডাকা শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রস্থল শাপলা চত্বরে যা ঘটেছিল, তা কেবল একটি রাজনৈতিক বা ধর্মীয় সংগঠনের ওপর আঘাত নয়– তা ছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের ভিত্তি এবং মানুষের মৌলিক অধিকারের ওপর এক সুপরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় আক্রমণ। রাষ্ট্র তার সর্বশক্তি নিয়ে নামেছিল নিজেরই নাগরিকদের বিরুদ্ধে, যারা ইসলামের সম্মান রক্ষায় রাসুল (সা.)-এর অবমাননার প্রতিবাদে এবং নিজেদের ন্যায্য ১৩ দফা দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে জমায়েত হয়েছিল।

সেদিন সকাল থেকে হাজার হাজার মানুষ, মাদরাসার ছাত্র, শিক্ষক, আলেম, সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ রাজধানীতে জমায়েত হতে থাকে। ঢাকার একপাশ থেকে আরেকপাশ পর্যন্ত ছিল আল্লাহর জিকির, স্লোগান, প্রতিবাদ আর অবিচারের বিরুদ্ধে ধৈর্যশীল অবস্থান। দিনের আলো নিভে যেতে না যেতেই বদলে যায় দৃশ্যপট। রাত গভীর হতেই শুরু হয় ভয়ংকর এক নিকষ কালো অভিযান। পুরো মতিঝিল এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হয়। চত্বরজুড়ে নেমে আসে গভীর অন্ধকার। সেই অন্ধকারে শুরু হয় একের পর এক সাউন্ড গ্রেনেড, গুলির শব্দ, ধোঁয়া আর অসহায় মানুষের আর্তনাদ।

রাষ্ট্র একে ‘অপারেশন ফ্লাশআউট’ বললেও, দেশের সাধারণ মানুষের চোখে এটি ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, গণহত্যা। রাষ্ট্রের প্রায় সব বাহিনী পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, সোয়াট, এপিবিএন– যেভাবে সমন্বিতভাবে এই অভিযানে অংশ নেয়, তা পূর্বপ্রস্তুত না হলে সম্ভব ছিল না। অস্ত্রের বহর দেখে মনে হয়েছিল যেন কোনো বিদেশি সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে। অথচ তারা কারা ছিল? এ দেশেরই মানুষ, দেশেরই ধর্মপ্রাণ সন্তান, কারও ভাই, কারও ছেলে, কারও স্বামী।

অনেকেই আশ্রয় নিয়েছিলেন পাশের মসজিদ, মার্কেট, ভবনের নিচ তলা বা দোকানে। কিন্তু সেই আশ্রয়স্থলও নিরাপদ ছিল না। এমনকি মসজিদের ভিতরেও হামলা চালানো হয়। গুলিতে ফাটে মাথা, ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরে। কারো মুখে ছিল কালেমা, কারো হাতে ছিল তসবিহ– তবুও নিস্তার মেলে না। চোখের সামনে একেকজন ভাই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কেউ কেউ চিৎকার করে মা কিংবা আল্লাহকে ডাকছিলেন, কিন্তু সাড়া মেলেনি। প্রতিটি গুলিতে যেন মৃত্যু শুধু একজন মানুষের নয়– একটি জাতির বিবেককেও ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হচ্ছিল।

রক্তাক্ত সেই রাতের পর শাপলা চত্বরকে ধুয়ে-মুছে পরদিন ভোরবেলায় এমনভাবে পরিষ্কার করে ফেলা হয়, যেন কিছুই ঘটেনি। যেন রাতে কেউ শহীদ হয়নি, কেউ কাঁদেনি, কেউ নিখোঁজ হয়নি। হাজার হাজার জুতা, রক্তমাখা জামাকাপড় আর ছিন্নভিন্ন কাপড়চোপড় গায়েব করে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রের এমন ব্যবস্থাপনায় মানুষ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিল—এত বড় একটি হত্যাকাণ্ড, অথচ কোনো চিহ্ন নেই? এ কেমন ব্যবস্থা, কেমন মানবতা?

ঘটনার পর বিচার তো দূরের কথা, নিহতদের সংখ্যা নিয়েও চলে গোপনীয়তা। অধিকার নামের একটি মানবাধিকার সংগঠন জানায় ৬১ জন নিহত হয়েছেন। হেফাজতের দাবিমতে, তাদের তৈরি তালিকায় শহীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৩০ জন। কিন্তু সেই তালিকা রাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে আজও আলোর মুখ দেখেনি। সরকার কখনো শহীদের নাম প্রকাশ করেনি, তাদের স্বজনদের পাশে দাঁড়ায়নি, বরং উল্টো পথে হেঁটেছে। নিহতদের পরিবার হারিয়েছে প্রিয়জনকে, কিন্তু পেয়েছে না কোনো বিচার, না কোনো সহানুভূতি। বহু পরিবার আজও জানে না, তাদের সন্তানের কবর কোথায়। কেউ নিখোঁজ, কেউ হয়তো অজানা কবরে।

যারা প্রশ্ন তোলে, তারা হয়ে ওঠে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’, ‘জঙ্গি-সমর্থক’, ‘ষড়যন্ত্রকারী’। মূলধারার গণমাধ্যম একে এক ভয়ানক ‘গণউত্থান’ বলে চালিয়ে দেয়, রাজনীতিকেরা মুখে কৌশলের মুখোশ পরিয়ে রাখে সত্যকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, সাংবাদিক সমাজে, নাগরিক প্ল্যাটফর্মে যাঁরা মানবাধিকারের ঝান্ডা ওড়ান, তাঁরাও এ ইস্যুতে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ধারণ করেন। এ নিস্তব্ধতা কেবল ভয়ের নয়, বরং তা সুবিধাবাদের, বুদ্ধিজীবী স্বার্থরক্ষারও নির্মম প্রহসন।

১১ বছর পেরিয়ে ২০২৪ সালের ১৮ অক্টোবর শাপলা চত্বর আবার উঠে আসে আলোচনায়। বাংলাদেশ পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বাবুল সরদার চাখারী দায়ের করেন একটি হত্যা মামলা, যাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩৪ জন অভিযুক্ত হন। এরপর হেফাজতের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরেকটি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। যেন এক নতুন আলোর রেখা দেখা দেয়। কিন্তু আমাদের ইতিহাস বলে—এ রকম বহু মামলাই মাঝপথে হারিয়ে যায় ক্ষমতার কূটকৌশলে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এ ইস্যুতে ছিল আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। তাদের ‘মানবাধিকার’ চেতনা একেক সময় একেকভাবে কাজ করে। কোনো কোনো গণহত্যা নিয়ে জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সরব থাকে, আবার কোনো ঘটনায় তারা নিরুত্তর। শাপলা চত্বর তার অন্যতম প্রমাণ।

রাষ্ট্র উন্নয়নের গল্প বলুক, মেগা প্রকল্পের ঢাক বাজাক, পদ্মা সেতুর নাম জপুক– সবই অর্থহীন হয়ে পড়ে, যদি ন্যায্য বিচার না থাকে, যদি রাষ্ট্র তার নিজ নাগরিকদের হত্যা করে মুখ ফিরিয়ে নেয়। যদি শহীদদের কোনো স্বীকৃতি না থাকে, যদি গণতন্ত্রের নামে জারি থাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস– তবে সে রাষ্ট্র উন্নয়নশীল নয়, সে রাষ্ট্র সংকীর্ণ, অমানবিক এবং আত্মবিরোধী।

আজ ১২ বছর পেরিয়ে গেছে। শাপলা চত্বরের শহীদদের নাম নেই কোনো শহীদ মিনারে, নেই কোনো রাষ্ট্রীয় স্মৃতিচিহ্নে। তাঁদের জন্য নেই একটি কাফনের কাপড়ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। অথচ তারা কেউ অন্যায় করেনি, লুটপাট করেনি, কারও বাড়ি আগুন দেয়নি—তারা শুধু চেয়েছিল ধর্মীয় অনুভূতির সম্মান, চেয়েছিল ইসলামকে অবমাননার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। এই দাবি কি এতটাই ভয়ংকর ছিল যে তার উত্তর দিতে হলো গুলিতে, রক্তে?

ইতিহাস অনেক কিছু ভুলে যায়, কিন্তু নিরীহ মানুষের রক্তকে কখনো বিস্মৃত হতে দেয় না। ইতিহাস অপেক্ষা করে, নীরব থাকে, কিন্তু সময়মতো সে জেগে ওঠে। একদিন এই জাতি জেগে উঠবেই। এবং জেগে উঠলে শাপলা চত্বরের শহীদরা ফিরে আসবে ইতিহাসের পাতায়, স্মৃতির দরজায়, জিজ্ঞাসার ভাষায়– ‘আমাদের রক্তের দায় নেবে কে?’

কেকে/ এমএস
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

ট্রাক ভাড়া করে ঘুরে ঘুরে ডাকাতি করত তারা
শিশু বলাৎকার ও হত্যার অভিযোগে কিশোর গ্রেফতার
১১ দিনে রেমিট্যান্স এলো প্রায় এক বিলিয়ন ডলার
মুরাদনগরের ওসি জাহিদুরের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বসহ নানা অভিযোগ, অপসারণ দাবি
জিয়া পরিবার জনগণের পরিবার : আমান উল্লাহ

সর্বাধিক পঠিত

আসছে নাটক ‘অপ্রকাশিত ভালোবাসা’
চিকিৎসক ও জনবল সংকটে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা
রাজশাহীতে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস পালিত
পাল্লা বাজারে রক্তলাল শাপলার মনভোলানো সমাহার
কালাইয়ে বিএনপির গণমিছিল ও লিফলেট বিতরণ

খোলা মত ও সম্পাদকীয়- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close