সাম্প্রতিক দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাড়ছে অবিশ্বাস, দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনা। নিজেদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ও কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েছে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ফ্যাসিবাদবিরোধীরাও। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এসবের নেপথ্যে রয়েছে সুপরিকল্পিত গেমপ্ল্যান, যার কেন্দ্রে রয়েছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’।
গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর অনেকে ভেবেছিলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপ কমবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। তথ্য-উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় ‘র’ সংস্থা এখনো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে বিভাজন তৈরি করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের পাঁয়তারা করছে।
বিএনপি ও জামায়াতের সাম্প্রতিক কিছু রাজনৈতিক অবস্থান এ সন্দেহকে আরো জোরালো করেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নিয়ে জামায়াতের হঠাৎ নরম আচরণ এবং বিএনপির নীরবতা সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জামায়াতের এক অনুষ্ঠানে বিতর্কিত সাংবাদিক সন্তোষ শর্মার উপস্থিতি, যিনি ভারতের স্বার্থের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে পরিচিত।
এদিকে ভারতীয়দের এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে আরেক তথ্য প্রকাশ করলেন সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান। তিনি তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পরও রাজেশ কুমার অগ্নিহোত্রী ঢাকায় অবস্থান করছেন এবং ভারতীয় হাইকমিশনের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর পরিচয়ে ‘র’-এর স্টেশন চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।’ তিনি লিখেন, ‘রাজেশ কুমার এখনো দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছেন এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতীয় স্বার্থে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।’ তাই দ্রুত রাজেশকে বাংলাদেশ থেকে ফেরত পাঠাতে সরকারের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর ভেতরেও ভারতপন্থি একটি গোষ্ঠীর প্রভাব নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন আরেক সাংবাদিক ইলিয়াস হোসাইন। তিনি তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে দলটির শীর্ষ নেতা ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহেরের ভূমিকা নিয়ে তুমুল সমালোচনা করেন।
তিনি লিখেন, ‘জামায়াত ইসলামের নেতাদের ফাঁসি হবার পেছনে জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতার সম্মতি ছিল। প্রথম সারির কয়েকজন নেতা মারা গেলে নিজেদের পদ পাকাপোক্ত হবে, এরকম পরিকল্পনা থেকে নেতাদের হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে শক্ত কোনো আন্দোলন করতে দেয়নি তারা। যাদের মধ্যে অন্যতম ভারতীয় এজেন্ট আবু তাহের। যিনি ৫ আগস্টের আগেও আওয়ামী লীগের পরামর্শে জামায়াতকে আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলো। যদিও তার সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে জামায়াত, বিশেষ করে শিবির আন্দোলন চালিয়ে যায়। তাহেরপন্থি নেতাদের কারনে জামায়াতের দেশপ্রেমিক নেতাদের ফাঁসির রায় হবার পরও শিবির চূড়ান্ত কোনো আন্দোলনে যাবার অনুমতি পায়নি। দেখে মনে হয়েছে নেতাদের হত্যা যেন জামায়াত সহজভাবেই মেনে নিয়েছিল, যা দেশের মানুষকে অবাক করে। অথচ বড় আন্দোলন করার সক্ষমতা শিবিরের ছিল যেটা তারা জুলাইয়ের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে প্রমাণ করেছে।
জামায়াতের শীর্ষ আরেকজন নেতা এটিএম আজাহারকে জেল থেকে বের করা হচ্ছে না জামায়াতের ওই একই অংশের কারণে সমালোচনা করেন তিনি আরো লিখেন, ‘জামায়াতের আরেকজন ফাঁসির আসামি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ৫ তারিখের পর দেশে ফেরার পরেও এ পর্যন্ত জামায়াতের কেন্দ্র থেকে কেউ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। এসব কিছুর কারণ একটাই তা হলো জামায়াতকে কট্টর ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে সরিয়ে আনা। কট্টর ভারতবিরোধী হওয়ার কারণেই কথিত যুদ্ধাপরাধে বিচারের নামে দলের চিহ্নিত ভারতবিরোধী নেতাদের হত্যা করা হয়। এমনকি ৭১-এ জামায়াত না করেও আমৃত্যু সাজা নিয়ে জেলে মরতে হয়েছে মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই জামায়াত কার্যত দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।’
তিনি লিখেন, ‘নিজেদের নেতাদের কুরবানি দিয়ে জামায়াতের কয়েকজন নেতা স্বপ্ন দেখছে ভারত তাদের ক্ষমতায় বসাবে অথবা স্বপ্ন দেখছে জামায়াতকে বিভক্ত করতে। ওইসব নেতারা জামায়াতকে ক্ষমতায় বসাবে নাকি বিভক্ত করে জামায়াতকে ধ্বংস করবে সেটা সময় বলে দিবে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনায় জামায়াত এবং শিবিরের মধ্যে প্রকাশ্যে বিভেদ দেখা গিয়েছে যা গণমাধ্যম পর্যন্ত পৌঁছেছে।’ জামায়াতের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা আগে কখনোই দেখা যায়নি, লিখেন তিনি।
অন্যদিকে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে একটি সূক্ষ্ম ও দীর্ঘমেয়াদি অপারেশন চলছে, যেখানে মূল টার্গেট হচ্ছে ভারতবিরোধী শক্তিগুলোকে দুর্বল করা এবং তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ সহজ করা। তাদের মতে, জামায়াতে ইসলামী এখন যে বিভক্তির মুখোমুখি, তা কেবল দলীয় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফল নয় বরং এর পেছনে রয়েছে বহিরাগত প্রভাব ও সুগভীর পরিকল্পনা। তারা বলছেন, একদিকে জামায়াতের কট্টর ভারতবিরোধী নেতাদের হত্যা বা কারাবন্দি করে দলকে দুর্বল করা হয়েছে, অন্যদিকে দলে ভারতপন্থি একটি অংশকে শক্তিশালী করে নতুন সমীকরণ দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে ইসলামী ছাত্র শিবিরের মতো সংগঠনের ভেতরেও ভাঙন ধরিয়ে ভবিষ্যতের শক্তিশালী প্রতিরোধ সম্ভাবনাকে ধ্বংস করার চেষ্টা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতীয় প্রভাব আরো দৃঢ় হবে এবং স্বাধীন রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার পক্ষে বড় হুমকি তৈরি হবে।
কেকে/ এমএস