ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ক্রমেই বিতর্কিত হয়ে পড়ছে। সেইসঙ্গে নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অনেকের বিরুদ্ধেও নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এতে তীব্র বিতর্কের মুখে পড়েছে বৈষমবিরোধীরা। রাজনীতিতে পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও দলের একাধিক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগে সাধারণ কর্মী-সমর্থকসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে বিরূপ ধারণা।
দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ পাচ্ছে একের পর এক অনিয়ম। বিশেষ করে এনসিপির অন্যতম নেতা সারজিস আলম ও সদ্য বরখাস্ত হওয়া যুগ্ম সদস্যসচিব সালাউদ্দিন তানভীরকে নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে ব্যাপক অসন্তোষ। সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে পাঠ্যবই ছাপা এবং জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগে কমিশন নেওয়ার অভিযোগ ওঠার পর তাকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানো হয়। বিষয়টি ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।
যদিও তানভীর নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে এক পয়সার দুর্নীতির প্রমাণ পেলে আমি নিজেই পদত্যাগ করব।’ অন্যদিকে এনসিপির আরেক নেতা সারজিস আলমকেও ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর তার রাজনৈতিক ধারা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলছেন, তিনি এখন পুরোনো ধাঁচের রাজনীতিতে ফিরে গেছেন। দেশের সিআইপি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা, জাঁকজমকপূর্ণ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ এবং নিজ এলাকায় রাজনৈতিক শোডাউনের বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি সাধারণ মানুষ। একইভাবে এনসিপির নেতা আব্দুল হান্নান মাসউদ সম্প্রতি হাতিয়ায় দামি গাড়িতে চড়ে গণসংযোগ চালিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার শিক্ষক বাবার নামে ঠিকাদারি লাইসেন্স নেওয়ার বিষয়টিও নতুন করে বিতর্ক তৈরি করেছে। যদিও সজীব ভূঁইয়া এই ইস্যুতে ব্যাখ্যা দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
এনসিপির অভ্যন্তরেও এসব ঘটনা নিয়ে অসন্তোষ বিরাজ করছে বলে জানিয়েছেন একাধিক নেতা। তারা বলছেন, যাদের নেতৃত্বে গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তারাই আজ সাধারণ মানুষের আস্থা হারাচ্ছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এনসিপির জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি হলো নেতৃত্বের সততা ও পরিপক্বতা প্রমাণ করা; তা না হলে দুর্নীতির অভিযোগ ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দেবে।
আসিফ মাহমুদের বাবার ঠিকাদারি লাইসেন্স বিতর্ক : নিজের বাবার নামে করা ঠিকাদারি লাইসেন্স নিয়ে সমালোচনা ওঠার পর এ প্রসঙ্গে মুখ খুলেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। গতকাল বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়া এই তরুণ।
তার আগে তার বাবা কুমিল্লার মুরাদনগরে বসবাসরত মো. বিল্লাল হোসেনের ঠিকাদারি লাইসেন্সের খবর ছড়িয়ে পড়েছিল ফেসবুকে। আসিফ যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে, সেই মন্ত্রণালয়ের কাজের জন্য তার বাবার ঠিকাদারি লাইসেন্স নেওয়ার সমালোচনাও উঠেছিল। গত ১৬ মার্চ বিল্লাল হোসেনের নামে লাইসেন্সটি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর, লাইসেন্সটি কুমিল্লা থেকে করা হয় বলে জানিয়েছিলেন সাংবাদিক জুলকারনাইন শায়ের।
তিনি বুধবার রাতে এক ফেসবুক পোস্টে খবরটি দিয়ে লিখেছিলেন, ‘এ বিষয়ে জানতে আমি উপদেষ্টা জনাব আসিফ মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি প্রথমে এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান ও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেন। তিনি সময় নিয়ে যাচাই করে জানান লাইসেন্স ও তালিকাভুক্তির বিষয়টি সঠিক, কিন্তু এটা তার জ্ঞাতসারে করা হয়নি। স্থানীয় জনৈক ঠিকাদার তার শিক্ষক পিতাকে ঠিকাদারি লাইসেন্সটি করতে এবং তালিকাভুক্ত করতে প্ররোচিত করেন।’
এরপর বাবার নামে করা সেই ঠিকাদারি লাইসেন্স বাতিল করে সেই আদেশের ছবি দিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে ফেসবুকে পোস্ট দেন আসিফ। তিনি লিখেছেন, ‘প্রথমেই আমার বাবার ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। গতকাল রাত ৯টার দিকে একজন সাংবাদিক কল দিয়ে আমার বাবার নামে ইস্যুকৃত ঠিকাদারি লাইসেন্সের বিষয়ে জানতে চাইলেন। বাবার সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হলাম, তিনি জেলা পর্যায়ের (জেলা নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ারের কার্যালয় থেকে ইস্যুকৃত) একটি লাইসেন্স করেছেন। বিষয়টি উক্ত সাংবাদিককে নিশ্চিত করলাম। তিনি পোস্ট করলেন, নিউজও হলো গণমাধ্যমে। নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে তাই ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলাম।’
স্থানীয় একজন ঠিকাদার কাজ পাওয়ার সুবিধায় তার বাবাকে লাইসেন্স করার পরামর্শ দিয়েছিলেন জানিয়ে আসিফ লিখেছেন, ‘বাবাও তার কথায় জেলা নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার থেকে একটি ঠিকাদারি লাইসেন্স করেন। রাষ্ট্রের যে কোনো ব্যক্তি ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে যে কোনো লাইসেন্স করতেই পারেন। তবে আমি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বরত থাকা অবস্থায় বাবার ঠিকাদারি ব্যবসায় জড়ানো স্পষ্টভাবেই কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। বিষয়টি বোঝানোর পর আজ বাবার আবেদনের প্রেক্ষিতে লাইসেন্সটি বাতিল করা হয়েছে। বাবা হয়তো কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের বিষয়টি বুঝতে পারেননি, সেজন্য বাবার পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’ আসিফ জানান, তার বাবার লাইসেন্স ব্যবহার করে কোনো কাজের জন্য আবেদন করা হয়নি।
সালাউদ্দিন তানভীরের তদবির বাণিজ্য : এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে তদবির বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে তার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক নিয়োগে প্রভাব বিস্তার এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে কেনাকাটায় কমিশন বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে বলে জানা যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে এনসিপি থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। দল থেকে তার বিরুদ্ধে ঘটনা তদন্তের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে গাজী সালাউদ্দিন তানভীর গণমাধ্যমকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে উপস্থাপিত সব অভিযোগের জবাব লিখিত আকারে দলীয় ফোরামে পেশ করা হবে। তখন বিষয়টি প্রেসকে জানানো হবে। সচিবালয়সহ বিভিন্ন স্থানে গাজী সালাউদ্দিনকে জড়িয়ে তদবির, প্রভাব বিস্তারসহ নানা ধরনের কথা শোনা গেলেও এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খোলেননি। তবে সম্প্রতি দলের সাধারণ সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় দলীয় ফোরাম থেকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি ওঠে। পরে সোমবার তাকে দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তদবির বাণিজ্যের মাধ্যমে গাজী সালাউদ্দীন ইতোমধ্যে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার এবং গৃহায়নসহ বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় গাজী সালাউদ্দিনের তদবিরে অতিষ্ঠ ছিল। সর্বশেষ সোমবারও তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান। এ সময় মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে তাকে একান্তে আলোচনা করতে দেখা যায়। এদিন সচিবালয়ে ৬নং ভবনের নিচে সাঙ্গপাঙ্গসহ দীর্ঘ সময় অবস্থানের পর বিকালের দিকে বেরিয়ে যান। গাজী সালাউদ্দিন দাবি করেন, তিনি জুলাই আন্দোলনের সমন্বয়ক।
সারজিসের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ : গাজী সালাউদ্দীন তানভীর ও জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের নিয়োগ সংক্রান্ত কেলেঙ্কারির তীব্র অভিযোগ তুলে ধরেছেন গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান। তার ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তিনি এ অভিযোগ করেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, গাজী সালাউদ্দীন তানভীর আওয়ামী লীগের তালিকাভুক্ত ডিসি নিয়োগের সমস্ত বন্দোবস্ত করেছে, যা সারজিস আলমের পরামর্শে সম্পন্ন হয়েছে। রাশেদ খান দাবি করেন, তিনি আগেই একটি প্রোগ্রামে এই বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন, যদিও সারজিস আলম পরবর্তীতে এটি অস্বীকার করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। তবে কয়েক মাস আগে রাশেদ খান সারজিস আলমের এক ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে নিশ্চিত হন যে, ডিসি নিয়োগে সারজিসের সম্পৃক্ততা সত্য।
এই কেলেঙ্কারির আরো গভীরে যাওয়া যায়, যখন এনসিটিবির (জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড) একটি কেলেঙ্কারিতে গাজী সালাউদ্দীন তানভীরের নাম উঠে আসে। রাশেদ খানের মতে, এখানেও তানভীরকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন সারজিস আলম। এ ছাড়াও সারজিস আলমের বিলাসবহুল গাড়ি চালানোর পেছনেও তানভীরের আর্থিক সহায়তা রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। ডিসি নিয়োগ, এনসিটিবির বাণিজ্যিক কার্যক্রম এবং বিভিন্ন তদবিরের মাধ্যমে গাজী সালাউদ্দীন তানভীর অর্থ উপার্জন করেছে বলে দাবি করা হয়েছে।
এর আগে সারজিস ঢাকা থেকে সৈয়দপুর পর্যন্ত গিয়েছেন উড়োজাহাজে চড়ে। বাকি ১০০ কিলোমিটার পথের মধ্যে অর্ধেকটা পাড়ি দিয়েছেন শতাধিক গাড়ির বহর নিয়ে। রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব পাওয়ার পর বাড়ি ফেরার পথে ‘শোডাউন’ দেন। যে বিষয়টি নিয়েও সমালোচনা তৈরি হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দলের ভেতরেও এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
এদিকে এসব অভিযোগের জবাবে সারজিস আলম ব্যাখ্যা দেন, তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং জেলার অনেক শুভাকাক্সক্ষী তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহরের অর্ধেকের বেশি গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। যেগুলোর ব্যয় তাদের বহন করতে হয়নি। বাকি ৫০টির মতো গাড়ির ৬০০০ টাকা করে যে তিন লাখ টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে, সেই টাকা দেওয়ার সামর্থ্য তার পরিবারের আরো ৫০ বছর আগেও ছিল। সারজিস আরো লিখেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, অন্য কেউ না; শুধু আমার দাদা আমার জন্য যতটুকু রেখে গিয়েছেন, সেটা দিয়ে আমি আমার ইলেকশনও করে ফেলতে পারব ইনশাআল্লাহ।’
দামি গাড়ি চড়েন হান্নান মাসউদ : কার দেওয়া গাড়িতে চড়েন সে বিষয়ে মুখ খুলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ। গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হান্নান মাসউদ বলেছেন, আমি নিজে একটা গাড়ি নিয়েছি। এ গাড়ির ব্যাপারে আমি অনেকবার বলেছি। এটা নিয়ে সাংবাদিকরাও বিভিন্ন নিউজ করেছেন। গাড়িটা কার সেটা বের করেছেন। এটা একজন ব্যবসায়ীর গাড়ি। যিনি মূলত একজন জামায়াতপন্থী ব্যবসায়ী। ওনার গাড়ি। উনি এটা আমাকে দেন। ভালো জেনেই দেন। উনি আমার হাতিয়ার মানুষ। উনি চান যে হাতিয়াতে আমি যেন রাজনীতিটা করি। এখন আমার বাড়িতে বাইকে যাওয়া তো রিস্কি। এখন তো আর আগের মতো যাতায়াত করা সম্ভব নয়। সেই ক্ষেত্রে এ সব বিষয় নিয়ে বারবার বিতর্ক তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমার এলাকার ৩০০ প্রবাসী আছেন। যারা একটা গ্রুপ করে নিয়মিত আমাকে টাকা-পয়সা দিয়ে যাচ্ছেন। তারা চান আমি যেন হাতিয়া থেকে নির্বাচন করে এমপি নির্বাচিত হই।
কেকে/ এমএস