রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে এখন ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহিদদের পরিবারের সদস্যরা চিকিৎসার অভাব, আর্থিক সহায়তা না পাওয়া ও ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছেন তারা। তাদের দাবি, ‘সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও এখনো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার পর্যাপ্ত সহায়তা পাচ্ছেন না। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে ভুগছেন আহতরা এবং আর্থিক সংকটে দিন কাটাচ্ছেন শহিদদের পরিবার।’
আহত ও শহিদ পরিবারদের অভিযোগ‘৫ আগস্টে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এখন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও দল গঠনে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারেরও তাদের প্রতি খুব একটা নজর নেই।’ তারা বলছেন, ‘অনেকের পরিবার মানবেতর জীবন পার করছে। অন্তর্বর্তী সরকার তাদের পুনর্বাসনে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। এমনকি হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার ও বিচারের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। শহিদদের এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। দ্রুততম সময়ে এসব দাবি পূরণ না হলে রাজপথে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তারা। অনেক শহিদ পরিবার মামলা করার কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, প্রতিনিয়ত পাচ্ছেন হুমকি-ধমকি।’
গত শনি ও রোববার গণঅভ্যুত্থানে আহতরা অসুস্থ শরীর নিয়ে রাজধানীর সড়কে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। এতে সড়কে স্থবিরতা দেখা দেয়। রোববার বেলা ১১টা থেকে শিশুমেলার সামনে তিন রাস্তার মোড়ে আহতরা তাদের দাবি আদায়ে অবস্থান শুরু করেন। এরপর সন্ধ্যায় মিরপুর সড়ক ছেড়ে বিক্ষোভরত ব্যক্তিরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে যাত্রা করেন। সন্ধ্যা ৭টা ৩৯ মিনিটে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে পৌঁছান তারা। সেখানে পুলিশের ব্যারিকেড দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একপর্যায়ে ওই জায়গায় বসে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ ছাড়া গত শনিবার রাত থেকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) সামনের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। এ সময় অনেকের হাতে স্যালাইন, ভাঙা পায়ে ব্যান্ডেজ ও ক্রাচে ভর করে সড়কে অবস্থান নিয়েছেন। আন্দোলনকারীদের ‘দালালি না বিপ্লব, বিপ্লব বিপ্লব’, ‘আস্থা নাই রে আস্থা নাই, দালালিতে আস্থা নাই’ চিকিৎসা চাই হয় মৃত্যু না হয় মুক্তি বৈষম্যবিরোধী এমন নানা স্লোগানও দিতে শোনা যায়।
আন্দোলনকারীদের একজন আমিনুল ইসলাম ইমন খোলা কাগজকে বলেন, শনিবার রাত থেকে তারা সড়কে অবস্থান করলেও সরকারের দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি তাদের সঙ্গে দেখা করা তো দূরের কথা, ন্যূনতম সহানুভূতিও দেখাননি। অথচ জুলাই আন্দোলনে নিহত ও আহত মানুষদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে এ সরকার ক্ষমতায় এসেছে।
আহতদের দাবি, তাদের রক্তের বিনিময়ে দেশ থেকে স্বৈরাচার বিদায় নিয়েছে। তারা কেউ পুলিশের গুলি খেয়েছে, কেউ টিয়ারশেলে অন্ধ হয়েছেন। আবার কেউ পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। তাদের কারণে যেই স্বাধীনতা সরকার ভোগ করছে, সেই তাদেরই চিকিৎসা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিতে অবহেলা করা হচ্ছে।
এর আগে গত শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক সংবাদ সম্মেলন করেন শহিদ পরিবারের সদস্যরা। সেখানে বলা হয়, দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে ৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শহিদ পরিবারগুলোর সদস্যদের সঙ্গে সরকার বৈঠক না করলে রাজপথে অবস্থান ও অনশন কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হবে। ৪ ফেব্রুয়ারি এ ঘোষণা আসবে। সংবাদ সম্মেলনের শিরোনাম ছিল, ‘প্রতিটি হত্যার আসামিদের দ্রুত গ্রেফতার ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা, শহিদ পরিবারের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সংবাদ সম্মেলন।’
সংবাদ সম্মেলনে অন্তত ২০টি শহিদ পরিবারের সদস্যরা বক্তব্য দিয়েছেন। সেখানে শহিদ ব্যক্তিদের কারো মা, কারো বাবা, কারো সন্তান, কারো ভাই, কারো স্ত্রী বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের একজন বীথি খাতুন। তার স্বামী হাফিজুর রহমান ৫ আগস্ট আগারগাঁও এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। ১৬ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। বীথি খাতুন সংবাদ সম্মেলনে ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘শহিদদের পরিবারের দাবি যদি মেনে না নেওয়া হয়, তবে আমাদেরও মেরে ফেলুন। আমাদের এখন বাঁচার কোনো দরকার নাই।’
নিজেদের অসহায়তা তুলে ধরে বীথি খাতুন বলেন, ‘আমার বাচ্চা তো আমাকেই বলে, মা আমি ভাত খাব। মা আমাকে এটা দাও। বাড়িওয়ালা তো আমাদের বলে না এক মাসের ভাড়া দিয়ো না। সরকার যদি আমাদের দাবি না মেনে নেয়, তবে সব শহিদ পরিবারকেই একেবারে শহিদ করে দিক। আমাদের মেরে ফেলা হোক, আমার বাচ্চাদেরও। তাহলে আমরা সবাই শহিদ হয়ে যাব।
যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত ইমাম হাসানের (তাইম) ভাই রবিউল আউয়াল। তিনি বলেন, ‘ভাই হত্যার বিচার চেয়ে ছয় মাস ধরে তিনি সরকারের বিভিন্ন দফতরে দফতরে ঘুরছেন। কিন্তু আসামিদের গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে না। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের ছয় মাস পরও শহিদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।’ দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাহদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ব্যস্ত দল গঠনে। আগামী ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ছাত্র-জনতার নতুন দল গঠনের ঘোষণা দেওয়ার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত। এসব কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা। সূত্রে জানা যায়, রাজনৈতিক দলের নাম চূড়ান্ত না হলেও এখন পর্যন্ত দেশের প্রায় সব জেলা কমিটি, ২৩৫ উপজেলা ও সাত উইং কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি দল গঠন নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল আমিন বলেছেন, ‘আমরা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি (চলতি মাসে) দল গঠন করব। সেই লক্ষ্যে আমাদের কাজ চলছে। বেশ ভালোভাবেই চলছে দল গঠনের কাজ। ইতোমধ্যে আন্দোলনের অংশীজন ছাত্র-জনতার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। অতিদ্রুতই রাজনৈতিক দল ঘোষণা হবে এবং ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নতুন দল গঠিত হবে। গতকাল রোববার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মারকলিপি প্রদান শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন।
এর আগে নতুন দল গঠন প্রসঙ্গে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা ১৫ ফেব্রুয়ারিকে ডেটলাইন ধরে নতুন দল ঘোষণার লক্ষ্যে কাজ এগিয়ে নিচ্ছি। দলের নাম ঠিক করা, কাঠামো তৈরি, গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র তৈরির কাজ চলমান রয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘নতুন দলে প্রথমে আহ্বায়ক কমিটি গঠন হবে। পরে কাউন্সিলের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করার পরিকল্পনা রয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক খোলা কাগজকে বলেন, জুলাই গণঅভুত্থানের শহিদদের নিয়ে জুলাই ‘শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠন হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে যেসব প্রতিশ্রুতি ছিল, বাস্তবে সে উদ্যোগগুলো তেমন গতি নেই। যদি বলি তাহলে আমাদের দলের (বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি) দুজন শহিদ ও আহতরা এখনো পর্যন্ত কোনো সহায়তা পায়নি। এটা একটি দৃশ্যমান ঘটনা। এ ছাড়া শহিদ এবং আহতদের ব্যাপারে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের যে বিষয়গুলো দ্রুতগতিতে দেখার কথা ছিল, সেখানেও আমরা একটু গাফিলতি দেখতে পাচ্ছি। যা ক্ষমাহীন, যেটা আমরা কোনোভাবে মেনে নিতে পারি না।’
শহিদ এবং আহতদের ব্যাপারে বৈষম্যবিরোধী নেতাদের আগ্রহের কিছু ঘাটতি রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘ছাত্র নেতারা রাজনৈতিক কাজে বেশি সময় দিতে গিয়ে শহিদ এবং আহতদের অধিকার আদায়ে তাদের মনোযোগে কিছুটা ঘাটতি লক্ষ্য করছি। তবে বিষয়টি (রাজনৈতিক কাজ) আমি দোষারোপ করছি না। কিন্তু আমি বলছি আহত ও শহিদ পরিবারের বিষয়টি যেন অগ্রাধিকার দিয়ে দেখা হয় এবং কার্যকরি উদ্যোগ নেন।’
কেকে/ এমএস