বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী শিল্প খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্প- দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। অথচ সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাপ্রবাহে এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটির সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক ক্রমশই দূরত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, যা অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবুর বক্তব্যে যে ক্ষোভ, হতাশা ও উদ্বেগ ফুটে উঠেছে, তা হালকাভাবে নেওয়ার মতো নয়। বিজিএমইএ নেতৃবৃন্দের অভিযোগ-সরকারি পর্যায়ে আলোচনার কোনো সুযোগ না পাওয়া প্রশাসনের সঙ্গে ব্যবসায়ী সমাজের দূরত্ব তৈরি হয়েছে যার ফলে নানারকম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সময় না দেওয়া, এবং একইসঙ্গে বিদেশি করপোরেট প্রতিনিধিদের অগ্রাধিকার দেওয়ার এমন অভিযোগ যদি সত্য হয়, তবে তা কেবল কূটনৈতিক নয়, দেশের অর্থনৈতিক বোঝাপড়াকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। দেশের ৪০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানিনির্ভর একটি শিল্প খাতকে উপেক্ষা করা মানে জাতীয় অর্থনীতির হৃৎপিণ্ডকেই ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া।
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ উভয়েরই আশঙ্কা, সদ্য প্রণীত ‘বাংলাদেশ শ্রম সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর কিছু ধারা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বিশেষ করে মাত্র ২০ জন শ্রমিক দিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের বিধান শিল্পাঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার অবশ্যই মৌলিক, কিন্তু সেটি এমনভাবে প্রণীত হতে হবে যাতে উৎপাদন বা বিনিয়োগ ব্যাহত না হয়। শ্রম আইন সংস্কার যদি শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তবে সেটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে পরিণত হবে। এছাড়া, চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল এক লাফে ৪১ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ী সমাজে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতারা যৌক্তিকভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন- যখন একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে মুনাফায় রয়েছে, তখন কেন একসঙ্গে এত বড় মাশুল বৃদ্ধি প্রয়োজন? বন্দরের কার্যকারিতা বাড়ানো, কনটেইনার ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন ও সার্ভিস ডিজিটালাইজেশন ছাড়া কেবল চার্জ বাড়ানোর কুফল শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের উপরই পরবে।
সবকিছু মিলিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট- সরকার ও ব্যবসায়ী মহলের মধ্যে যে আস্থা ও যোগাযোগের সেতু থাকা উচিত, তা ভেঙে পড়ছে। অথচ এই আস্থাই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক বিনিয়োগের মূল ভিত্তি। এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রাক্কালে দেশের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নীতিনির্ধারক ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে খোলামেলা সংলাপ, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহযোগিতামূলক মনোভাব।
সরকারের উচিত হবে ব্যবসায়ী সমাজের সঙ্গে নিয়মিত পরামর্শমূলক বৈঠক করা, শ্রম আইন বাস্তবতার আলোকে পুনর্মূল্যায়ন করা এবং রপ্তানিমুখী খাতের জন্য প্রণোদনামূলক নীতি নির্ধারণ করা। অন্যথায়, বিদেশি বাজারে প্রতিযোগিতা হারানোর পাশাপাশি দেশীয় বিনিয়োগও সংকুচিত হবে- যা সামগ্রিক অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে।
বাংলাদেশের অগ্রগতি কোনো একক পক্ষের হাতে নয়- এটি সরকার, শ্রমিক ও উদ্যোক্তা এই তিন পক্ষের সম্মিলিত প্রয়াসের ফল। এই বাস্তবতা ভুলে গেলে উন্নয়ন থমকে যাবে। ফলে আন্তর্বর্তী সরকারের উচিত বিনিয়োগ ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংলাপ ও পারস্পরিক সহযোগিতার নতুন রাস্তা তৈরি করা।
কেকে/এআর