তথ্যপ্রযুক্তি ও অটোমেশনের দ্রুত বিস্তার বাংলাদেশের জন্য যেমন সম্ভাবনা বয়ে আনছে, তেমনি বড় ধরনের ঝুঁকিও তৈরি করছে। এটুআই ও ইউএনডিপির ২০১৯ সালের যৌথ গবেষণা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে শুধু তৈরি পোশাক, কৃষি ও পর্যটন খাতেই প্রায় ৫৮ লাখ ৯০ হাজার মানুষের চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। এ সংখ্যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের একটি বড় অংশ। এর বাইরে খাদ্য, ফার্নিচার ও হসপিটালিটি খাতেও একই ধরনের প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে স্মার্ট মানবসম্পদ উন্নয়ন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এই উদ্বেগ নতুনভাবে সামনে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন- দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক অর্থনীতিতে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে এখনই দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বব্যাপী চাকরির বাজারের এক-চতুর্থাংশ পরিবর্তিত হবে। ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ তার মূল প্রবন্ধে বলেন, বিশ্বব্যাপী নতুন প্রযুক্তিনির্ভর খাতে ১৭ কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেও প্রায় ৯ কোটি ২০ লাখ মানুষ তাদের বর্তমান চাকরি হারাবেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এ ঝুঁকি বাস্তব- বিশেষ করে তৈরি পোশাক, কৃষি ও পর্যটন খাতে।
ফলে আগত এই সংকট মোকাবিলায় চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে শুধু ‘দক্ষতা’ নয়, আমদের প্রয়োজন প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর সক্ষমতা ও সৃজনশীল চিন্তা। দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৭৬ হলেও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সীমিত। এই ঘাটতি দূর করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় যুগোপযোগী পরিবর্তন আনতে হবে, কারিগরি শিক্ষাকে মূলধারায় আনতে হবে।
এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কর্মসংস্থান সংকুচিত করার চেয়ে কাজের ধরনে পরিবর্তন আনছে। ফলে আমদেরকে সেইভাবেই নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে অর্থাৎ এটিকে হুমকি হিসেবে না দেখে, সঠিকভাবে প্রস্তুতি নিলে এটি হয়ে উঠবে আমদের কর্মক্ষেত্রের নতুন সুযোগের দরজা। কিন্তু প্রস্তুতি কই?
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাসরুর আলী স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন- শিক্ষার মানে বৈষম্য, বিশেষ করে শহর ও গ্রামের মধ্যে, ভবিষ্যতের দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির বড় বাধা। দেশের শিক্ষার্থীদের মাত্র ২০ শতাংশ তাদের অর্জিত দক্ষতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চাকরি পাচ্ছেন। বাকি ৮০ শতাংশ হয় বেকার, নয়তো অদক্ষ খাতে ঠাঁই নিচ্ছেন।
এই বাস্তবতায় প্রশ্ন একটাই- আমরা কি প্রস্তুত?
যদি এখনই কারিগরি শিক্ষা, ভাষা শিক্ষা, আইসিটি প্রশিক্ষণ ও উদ্যোক্তা দক্ষতার ওপর জোর না দেওয়া হয়, তবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ঢেউ বাংলাদেশের শ্রমবাজারকে বিপর্যস্ত করে ফেলবে।
এখনই সময় জাতীয় পর্যায়ে একটি সমন্বিত মানবসম্পদ উন্নয়ন রূপরেখা প্রণয়নের। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এনএসডিএ, শিল্প মন্ত্রণালয়, বেসরকারি খাত ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে একটি ‘দক্ষতা উন্নয়ন কাউন্সিল’ গঠন করা যেতে পারে, যা বাস্তবতার আলোকে পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ তদারকি করবে। এলডিসি-পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশকে ‘সস্তা শ্রমনির্ভর অর্থনীতি’ থেকে ‘দক্ষতা ও উদ্ভাবননির্ভর অর্থনীতিতে’ রূপান্তরিত করতেই হবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ঢেউ ঠেকানো যাবে না- তবে সঠিক প্রস্তুতি নিলে সেটিই হতে পারে আমাদের পরবর্তী অগ্রযাত্রার হাতিয়ার।
কেকে/এআর