প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ জমা দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গত বুধবার এ সুপারিশ হস্তান্তর করা হয়। তবে সুপারিশের কিছু ধারা নিয়ে অসন্তোষ জানিয়েছে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অভিযোগ করেছেন, ঐকমত্য কমিশন অনৈক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কমিশন যেভাবে তাদের সুপারিশ দিয়েছে, তা এক দিকে যেমন কমিশনের এত দিনের কাজকে অর্থহীন বলে প্রমাণ করার ঝুঁকি তৈরি করেছে, অপরদিকে দেশকে ঠেলে দিতে পারে রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে।
ঐকমত্য কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সংবিধানের সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে গণভোটে রাজনৈতিক দলের ভিন্নমতের বিষয় উল্লেখ থাকবে না। ঐকমত্য কমিশন যেভাবে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, তার ওপরই গণভোট হবে। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে ঐকমত্য কমিশন যেভাবে সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, সেভাবেই তা বাস্তবায়িত হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এনসিপির স্বাক্ষর শেষ মুহূর্তে নিশ্চিত করতে তাদের দেওয়া শর্ত মেনেই এমন প্রস্তাব করেছেন তারা। রাজনৈতিক দর-কষাকষির জন্য এমন শর্ত দেওয়াটা চলতে পারে, কিন্তু সেটাকে সনদ স্বাক্ষরের অলঙ্ঘনীয় শর্ত বানিয়ে ফেলা রাজনৈতিক অপরিপক্বতা। বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) বাদ দিয়ে গণভোটের প্রস্তাবকেও অর্থহীন মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের প্রশ্ন, ভিন্নমত না রাখলে, তবে কেন মাসের পর মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অতি দীর্ঘ আলোচনা করা হলো?
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি যদি এই গণভোট মেনে নেয় এবং ‘না’ ভোটের পক্ষে যায়, তার সঙ্গে যদি পতিত স্বৈরাচার এবং তার দোসরদের ‘না’ ভোট যুক্ত হয়ে যদি ‘না’ বিজয়ী হয়, তাহলে তো পুরো সংস্কারপ্রক্রিয়া ভেস্তে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, এভাবে গণভোট হওয়াটা যদি বিএনপি গ্রহণ না করে এবং এর বিরুদ্ধে মাঠে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন কী হবে?
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমতো সরকার গণভোটের আয়োজন করতে গেলে দেশে অনিবার্যভাবেই সংঘাত তৈরির পরিস্থিতি হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমনিতেই দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে এমন সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই পরিস্থিতিকে আরো সংঘাতময় করে তুলবে।’
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশকে জাতির সঙ্গে প্রতারণা বলে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, সুপারিশে বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট’ পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এটা ঐক্য হতে পারে না। তাহলে এই কমিশন কেন করা হয়েছিল?’ তিনি বলেন, ‘জনগণের সঙ্গে এটা একটা প্রতারণা। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও প্রতারণা।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, যে বিষয়গুলোতে তারা একমত ছিলেন না, সেখানে তারা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন। সেই নোট অব ডিসেন্ট সুপারিশে লিপিবদ্ধ করার একটা প্রতিশ্রুতি ছিল কমিশনের। কিন্তু অবাক হয়ে তারা লক্ষ করলেন, সুপারিশে সেই বিষয়গুলো নেই। নোট অব ডিসেন্টগুলো পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আপনি কিন্তু এইবার জনগণের সামনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, ওয়াদাবদ্ধ। আপনি এখানে সত্যিকার অর্থেই যেটুকু সংস্কার দরকার, সেই সংস্কারগুলো করে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন দেবেন। সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে পার্লামেন্ট আসবে, সেই পার্লামেন্ট এই দেশের সংকটগুলো সমাধান করবে। সুতরাং আজকে যদি এর থেকে কোনো ব্যত্যয় ঘটে, এর থেকে বাইরে যদি যান, তার দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ আপনাকেই বহন করতে হবে। এ কথাটা আমি খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে জুলাই সনদে পূর্ণ প্রতিফলন নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় যে সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে, কমিশনের দেওয়া সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে তার হুবহু প্রতিফলন নেই। তিনি বলেন, ‘এতদিন আমরা মনে করতাম, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রেফারির ভূমিকা পালন করছে।
রেফারিকে আমরা কখনো গোল দিতে দেখিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ঐকমত্য কমিশন, সরকার এবং আরো দু-তিনটি রাজনৈতিক দল একই পক্ষ। আমি বিপক্ষেই খেলছিলাম মনে হয়। সেই হিসেবে জাতির পক্ষের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি।’ সুপারিশে কিছু দলের প্রস্তাব ও ঐকমত্য কমিশনের চিন্তাভাবনা জাতির ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ করেছেন বলে মন্তব্য করেন সালাহউদ্দিন আহমদ।
এদিকে ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘যদি গণভোটে জুলাই সনদ পাস না হয়, তবে জুলাইয়ে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের আত্মত্যাগ ব্যর্থ হয়ে যাবে। এ জন্য জুলাই সনদ পাস করানোর দায়িত্ব সবার।’
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমরা জুলাই সনদের প্রস্তাবনা ইতোমধ্যে জমা দিয়েছি। এখন সরকার এগুলো নিয়ে কাজ করবে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে অতীতেও অনেক আন্দোলন হয়েছে। সেসব আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। মানুষের আত্মত্যাগের আকাক্সক্ষা অপূর্ণ রয়ে গেছে। কিন্তু এবার যেন ব্যর্থ না হয়।’
জুলাই সনদ পাস করতে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ছাত্রসংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তোমাদের দায়িত্ব আরো বেশি। আমি জানি না, গণভোট কখন হবে। তবে গণভোটে যদি জুলাই সনদ পাস না হয়, তাহলে সব আত্মত্যাগ ব্যর্থ হয়ে যাবে।’
কেকে/এআর