দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি এখন এমন এক জটিল ঘূর্ণাবর্তে পতিত, যেখানে প্রতিটি অর্থনৈতিক সূচক একইসঙ্গে সতর্ক সংকেত দিচ্ছে। একদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতা, অন্যদিকে রাজস্ব ঘাটতির ক্রমবর্ধমান চাপ-এ দুটি উপাদান আজ রাষ্ট্রের আর্থিক শিরা-উপশিরায় জমাটবাঁধা রক্তের মতো অচলতা সৃষ্টি করেছে। সরকারি রাজস্ব আদায় পরিকল্পিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে পড়ছে, বিনিয়োগে স্থবিরতা ছড়িয়ে পড়ছে, উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে এবং কর্মসংস্থানের বাজার দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৯ শতাংশ। এ ঘাটতি শুধু পরিসংখ্যান নয়- এটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক জীবনীশক্তির ম্লান হয়ে আসার এক দৃশ্যমান প্রতিফলন। অর্থনীতির ইতিহাসে রাজস্ব ঘাটতি সব সময় ব্যবসা মন্দার এক অনিবার্য ছায়া হিসেবে ধরা দেয়। যখন ব্যবসা থমকে যায়, বাজারে ক্রেতা-চাহিদা কমে, উৎপাদন ব্যাহত হয়, তখন সরকারের রাজস্ব আদায়ও স্বাভাবিকভাবে কমে আসে। বাংলাদেশ এখন সেই বাস্তবতার মুখোমুখি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স এবং রপ্তানিতে কিছুটা সাময়িক স্বস্তি মিললেও সামগ্রিক ব্যবসা ও বিনিয়োগ খাত ক্রমেই গতি হারাচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, জ্বালানির অনিশ্চয়তা, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তহীনতা মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি এখন এক স্থবির বৃত্তে আবদ্ধ।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর ব্যবসা ও বিনিয়োগ খাতে এক ধরনের আশার সঞ্চার হয়েছিল। দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা নেতৃত্বে থাকায় মনে করা হয়েছিল- অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার হবে, স্থবিরতা কাটবে, রাজস্ব প্রবাহে গতি ফিরবে। কিন্তু প্রায় ১৪ মাস পরও সেই প্রত্যাশার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। রেমিট্যান্স ও রিজার্ভে সামান্য ইতিবাচক সাড়া থাকলেও বিনিয়োগ, শিল্পোৎপাদন ও কর্মসংস্থানে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি ঘটেনি। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. সাদিক আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সরকারি ও বেসরকারি উভয়ক্ষেত্রেই ব্যয় কমে গেছে। বিনিয়োগকারীরা এখন অত্যন্ত সতর্ক, কারণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জ্বালানি খাতের অনিশ্চয়তা ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা তাদের আস্থাহীন করে তুলেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি এখনো বিদ্যমান। দেশে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় ভিয়েতনাম বা ভারতের তুলনায় অনেক বেশি। এই ব্যয় কাঠামো পুনর্গঠন ছাড়া অর্থনীতিতে গতি ফিরবে না।’
অর্থনীতির সাম্প্রতিক চিত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, আগস্ট মাসে আমদানি ব্যয় কমেছে ১৬.৭১ শতাংশ, যা শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে শিল্প উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, নতুন প্রকল্প স্থগিত থাকছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। যদিও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ৩২.১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, তবুও অর্থনীতিবিদরা একে ‘বিকৃত স্বস্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কারণ এ রিজার্ভ বৃদ্ধি প্রকৃত অর্থে অর্থনৈতিক গতি নয়, বরং আমদানি সংকোচনের প্রতিফলন। অর্থাৎ রিজার্ভ যত না ‘স্বস্তির বার্তা’, তার চেয়ে বেশি ‘আশঙ্কার ইঙ্গিত’।
অর্থনীতির ভাষায় একে বলা যায় ‘নিষ্ক্রিয় স্বস্তি’-যেখানে রিজার্ভ বাড়লেও প্রকৃত উৎপাদন থেমে যায়। শিল্পে যখন কাঁচামাল প্রবেশ করে না, তখন উৎপাদন হ্রাস পায়; উৎপাদন কমলে কর্মসংস্থান কমে যায়; কর্মসংস্থান কমলে মানুষের আয় হ্রাস পায়; আর আয় কমে গেলে রাজস্ব আদায়ও কমে যায়। এ চক্রই এখন বাংলাদেশের রাজস্ব ঘাটতির মূল কারণ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এখন রাজস্ব আদায়ে মরিয়া হয়ে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে- বকেয়া কর আদায়, কর ফাঁকি প্রতিরোধ, মামলায় আটকে থাকা রাজস্ব পুনরুদ্ধার, ডিজিটাল অটোমেশন বৃদ্ধি, এবং করদাতাবান্ধব উদ্যোগের ঘোষণা। কিন্তু ব্যবসা যখন স্থবির, তখন এসব উদ্যোগ বাস্তবে খুব বেশি ফলপ্রসূ হচ্ছে না। এনবিআরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা। কর আদায়ের জন্য অতিরিক্ত চাপ দিলে প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকতে পারবে না। রাজস্ব আদায় তখন আরও হ্রাস পাবে।’ এ মন্তব্য অর্থনীতির এক গভীর সত্য প্রকাশ করে- রাজস্ব আদায়ের সক্ষমতা অর্থনৈতিক কার্যক্রমের গতির ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ রাষ্ট্র যত বেশি উৎপাদন ও লেনদেনের সুযোগ সৃষ্টি করবে, রাজস্ব তত বেশি হবে। কিন্তু বর্তমানে শিল্পের চাকা ঘুরছে ধীরগতিতে। ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট, উচ্চ সুদের হার, এবং ঋণপ্রবাহে কড়াকড়ি- সব মিলিয়ে উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্পে যেতে পারছেন না।
অন্যদিকে, মূল্যস্ফীতির চাপও জনগণের ভোগব্যয় সংকুচিত করে ফেলেছে। সরকারি তথ্যমতে, সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৮.৩৬ শতাংশ, যা আগস্টের ৮.২৯ শতাংশের তুলনায় বেশি। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী নয়; বরং ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী। বাসাভাড়া, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। ফলে বাজারে চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে, ব্যবসার টার্নওভার কমছে, আর রাজস্ব প্রবাহও স্থবির হয়ে পড়ছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে সর্বাধিক ৪.৮ শতাংশ, যা গত কয়েক বছরের গড় ৬ শতাংশের তুলনায় অনেক কম। প্রবৃদ্ধি কমলে স্বাভাবিকভাবেই রাজস্ব আদায় কমে যায়, কারণ উৎপাদন ও লেনদেনের ওপরই রাজস্ব নির্ভরশীল।
কর বিশেষজ্ঞ স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, ‘রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে বাস্তব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিবেচনা করা হয় না। কাগজে কলমে উচ্চ লক্ষ্য নির্ধারণ করলেই তা অর্জন সম্ভব নয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘সিগারেট খাতের মতো কিছু নির্দিষ্ট খাত না থাকলে রাজস্ব পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতো।’ অর্থাৎ রাজস্ব কাঠামো এখন সীমিত কিছু খাতের ওপর নির্ভরশীল, যা অর্থনীতির বৈচিত্র্যহীনতার লক্ষণ। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও একই বার্তা দিচ্ছেন। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরএন পাল বলেন, ‘দেশে উৎপাদন ও ভোগ দুই-ই কমে গেছে। ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় বিক্রি কমছে, ফলে সরকারের রাজস্ব আদায়ও স্বাভাবিকভাবে কমছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ব্যাংকগুলো এখন ঋণ প্রদানে অতিরিক্ত সতর্ক। বিনিয়োগ না বাড়লে বেচাকেনা বাড়বে না, রাজস্বও বাড়বে না।’
অন্যদিকে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক না থাকলে বিনিয়োগ হয় না। সরকার সহায়তা না দিলে কেউ বড় বিনিয়োগে আগাবে না। সবাই এখন অপেক্ষা করছে রাজনৈতিক সরকার আসার পর কী সিদ্ধান্ত হয়।’ এ অপেক্ষার সংস্কৃতি অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। কারণ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত বিলম্বিত হলে উৎপাদন পিছিয়ে যায়, কর্মসংস্থান থমকে যায়, আর রাজস্ব প্রবাহ শুকিয়ে আসে।
অর্থনীতির এ রকম মন্থর বাস্তবতায় রিজার্ভ বৃদ্ধি বা রেমিট্যান্সে সামান্য উত্থান শুধু ভাসমান আশ্বাস মাত্র। প্রকৃত অর্থে অর্থনীতি এখন ‘বিনিয়োগহীন প্রবৃদ্ধি’র পথে হাঁটছে- যেখানে সংখ্যা আছে, কিন্তু কার্যক্রম নেই। রাজস্ব ঘাটতি তার সরাসরি প্রতিফলন। রাজস্ব ঘাটতি মানে উন্নয়ন বাজেটে কাটছাঁট, সামাজিক খাতে অর্থায়ন হ্রাস, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ব্যয় সংকোচন। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের ওপর পড়বে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এখন প্রয়োজন ‘কাঠামোগত পুনর্গঠন’। প্রথমত, কর প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও অটোমেশন নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ছোট ও মাঝারি ব্যবসা খাতকে করনীতির আওতায় এনে রাজস্বের ভিত্তি প্রসারিত করতে হবে। তৃতীয়ত বিনিয়োগবান্ধব নীতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক আস্থা ছাড়া অর্থনীতি টেকসই হতে পারে না। আজ উদ্যোক্তারা দ্বিধান্বিত- নির্বাচনের পর কোন সরকার আসবে, কী নীতি প্রয়োগ হবে, তা কেউ জানে না। এ অনিশ্চয়তা বিনিয়োগে ভয় সৃষ্টি করছে। অথচ বিনিয়োগ ছাড়া রাজস্ব বৃদ্ধি সম্ভব নয়।
অর্থনীতির মৌলিক সূত্র স্পষ্ট-রাজস্ব আয় তখনই বাড়ে, যখন জনগণের আয় বাড়ে; জনগণের আয় বাড়ে তখনই, যখন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়; আর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় তখনই, যখন ব্যবসায় আস্থা ফিরে আসে। অতএব, রাজস্ব ঘাটতি কোনো বিচ্ছিন্ন সমস্যা নয়, এটি পুরো অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রতিফলন। বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে স্বল্পমেয়াদি রাজস্ব লক্ষ্য নয় বরং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা নিতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে নির্ভরযোগ্যতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, কর নীতির পূর্বানুমানযোগ্যতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা- এই চারটি শর্ত পূরণ ছাড়া ব্যবসায় গতি ফিরবে না, রাজস্বও বাড়বে না। আজ রাজস্ব ঘাটতি শুধু সংখ্যার বিষয় নয়- এটি আস্থার সংকট, নীতির ব্যর্থতা এবং অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতার সম্মিলিত প্রতিচ্ছবি। যদি এখনই প্রয়োজনীয় সংস্কার না নেওয়া হয়, তাহলে এ ঘাটতি আরো বাড়বে, যা ভবিষ্যৎ বাজেট, উন্নয়ন প্রকল্প ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে বিপর্যস্ত করবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি একসময় প্রবৃদ্ধির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। এখন প্রয়োজন নতুন এক দৃষ্টান্ত-‘আর্থিক শৃঙ্খলা ও আস্থার পুনর্জাগরণ’। রাজস্ব ঘাটতি পূরণ করতে হলে প্রথমেই ব্যবসার আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আস্থা ফিরলে বিনিয়োগ বাড়বে, উৎপাদন বাড়বে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং রাষ্ট্রের রাজস্বও স্বাভাবিকভাবে বাড়বে।
অর্থনীতি কোনো অলৌকিক শক্তি নয়; এটি মানুষের বিশ্বাস, নীতি ও কর্মকাণ্ডের সম্মিলিত ফল। ব্যবসা মন্দার এ অচলাবস্থা কাটিয়ে রাজস্বে গতি ফেরানোই এখন রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সময় এসেছে মুখোশ খুলে বাস্তব সংস্কারের পথে হাঁটার- কারণ রাজস্ব ঘাটতি শুধু হিসাবের নয়, এটি জাতির অর্থনৈতিক আত্মবিশ্বাসের পরীক্ষা।
লেখক : শিক্ষক ও কলাম লেখক
কেকে/এআর