জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট চায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটি বলছে, ঐকমত্য কমিশন নির্বাচনের দিন বা এর আগে গণভোটের সুপারিশ করেছে সরকারের কাছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটই সঠিক সিদ্ধান্ত। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে নির্বাচন হওয়ার সুযোগ নেই। জামায়াত ও এনসিপির শীর্ষনেতাদের এ ধরনের বক্তব্যে কিছুটা উদ্বিগ্ন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট বাস্তবসম্মত নয়। কারণ জাতীয় নির্বাচন যদি ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয়, তবে তার আগে গণভোট আয়োজন করার মতো অবস্থা দেশের পরিস্থিতিতে নেই। এ ছাড়া গণভোট প্রশ্নে রাজনৈতিক মতভিন্নতা রয়েছে। এ ছাড়া জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে সুপারিশ ঐকমত্য কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে, তার কিছু বিষয় নিয়ে বিএনপিসহ কিছু দলের অসন্তোষ আছে। সব মিলিয়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট রাজনৈতিক সংকটই বাড়াবে। পিছিয়ে বা ভেস্তে যেতে পারে জাতীয় নির্বাচন।
অন্যদিকে গণভোট নিয়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে। তারা জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে হলেও গণভোট চাচ্ছেন। গতকাল বুধবার জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের দাবি করেছেন, জাতীয় নির্বাচন ঠিক সময়ে না হলেও গণভোট আগে দিতে হবে। একই দিন দলটির সেক্রেটারি জেনারেল বলেছেন, গণভোটের তারিখ ঘোষণায় যত দেরি হবে, জাতীয় নির্বাচন তত সংকটের মধ্যে পড়বে।
জামায়াতের দুই শীর্ষনেতার এমন বক্তব্যে নির্বাচন ঠেকানোর দুরভিসন্ধি দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, জামায়াত নির্বাচনের আগে নানা ইস্যু নিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, দলটির জাতীয় নির্বাচনে যেতে অনাগ্রহী। শুধু তা-ই নয়, দলটি চাচ্ছে নির্বাচন যেন ফেব্রুয়ারিতেই অনুষ্ঠিত না হয়। তারই প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে দলটির নায়েবে আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলের গতকালকের বক্তব্যে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সময় বাকি আছে সর্বোচ্চ সাড়ে তিন মাস। সরকার এমনিতেই নানা সংকটে জেরবার। দেশের অর্থনীতি ভালো চলছে না, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট নাজুক। এ অবস্থায় গণভোট অনুষ্ঠিত হলে, তা নতুন সংকট তৈরি করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত আরো বাড়বে। উদ্ভূত পরিস্থিতি জাতীয় নির্বাচনকেই অনিশ্চিত করে তুলবে।
জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোটে সুবিধা দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট হলে একটা সুবিধা পাওয়া যাবে। দলগুলো তাদের অনুমোদিত সংস্কারকে নির্বাচনি ইশতেহারে যুক্ত করতে পারবে। এতে এটাও বোঝা যাবে, জনগণ কতটুকু সংস্কার গ্রহণ করতে এই মুহূর্তে প্রস্তুত। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি আসলে নির্বাচন বানচালেরই অজুহাত।
এদিকে নির্বাচন বানচালের আশঙ্কা দেখছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও। গতকাল আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি সংক্রান্ত সভায় তিনি বলেন, ‘নির্বাচন বানচালের জন্য ভেতর থেকে, বাইরে থেকে অনেক শক্তি কাজ করবে। ছোটখাটো না, বড় শক্তি নিয়ে বানচালের চেষ্টা করবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘হঠাৎ করে আক্রমণ চলে আসতে পারে। এই নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে। যত ঝড়ঝঞ্ঝাই আসুক আমাদের সেটা অতিক্রম করতেই হবে।’
যা বলেছেন জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতা: গতকাল রাজধানীর মগবাজারে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে আবদুল্লাহ তাহের বলেন, ‘কোনো কারণে যদি জাতীয় নির্বাচন সঠিক সময়ে নাও হতে পারে, আমরা আশা করি, সঠিক সময়ে ইনশাআল্লাহ হবে, তখনো তো জুলাই সনদ আমাদের পাস করতে হবে। জুলাই সনদ তো একটা সংস্কারও। সুতরাং দুটোকে একসঙ্গে জুড়ে দেওয়াটা এটা আমরা কোনোভাবেই সঠিক মনে করি না। এটা জুলাই সনদকে অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যেতে পারে।’
অন্যদিকে অবিলম্বে গণভোটের তারিখ ঘোষণার দাবি জানিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, গণভোটের তারিখ ঘোষণায় যত দেরি হবে, জাতীয় নির্বাচন তত সংকটের মধ্যে পড়বে। তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, সেখানে গণভোট কখন হবে, সেটি স্পষ্ট করে বলেনি। এর মাধ্যমে গণভোটের তারিখ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে একটা জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ‘বল’ চলে গেছে সরকারের কোর্টে। এ বিষয়ে এখন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে নির্বাচনের সুযোগ নেই :
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না হলে নির্বাচন হওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, জুলাই সনদ এবং বিচারের রোডম্যাপ দিয়ে তারপর নির্বাচনের দিকে যেতে হবে। আমরাও দ্রুত নির্বাচন চাই। দেশে একটা স্থিতিশীলতার প্রয়োজন, আস্থার প্রয়োজন। এ কারণে দ্রুত সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ৫ আগস্টের পর আমরা দেখেছি দেশে দুর্নীতি এবং দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি নতুন করে শুরু হয়েছে। অন্যদিকে আমরা সামাজিক ফ্যাসিবাদের উত্থান দেখতে পারছি। দেশে কিন্তু আসলে নানামুখী সংকট আছে। তিনি বলেন, কেউ যদি মনে করে যে তারা এককভাবে সবকিছুর নেতৃত্ব দেবে বা সরকার গঠন করে ফেলবে, সেটা কিন্তু সম্ভব হবে না। যদি ন্যূনতম ঐক্য না থাকে দেশের সবগুলো পক্ষের মধ্যে, তাহলে সেই সরকার টেকানো সম্ভব হবে না।
কেকে/এআর