আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এদিকে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক দল ও আমলাদের পক্ষ থেকে ততই অসহযোগিতা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সব দলই সার্বিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে তারা সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে। অন্যদিকে আমলারা তাকিয়ে আছেন আগামী সরকারের দিকে। এর ফলে বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের সাম্প্রতিক বক্তব্যে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী কাড়াকাড়ি করে প্রশাসনিক জায়গাগুলোতে তাদের লোক নিয়োগ করিয়েছে। নিয়োগের আগে তারা সংস্কারের জন্য সরকারকে যত সময় লাগে দেওয়ার পক্ষে ছিল। তবে নিয়োগ শেষ হওয়ার পরপরই ডিসেম্বর মাস থেকে তারা অসহযোগ শুরু করে দিয়েছে।’
তবে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সরকারকে অসহযোগিতার অভিযোগ খুব বেশি তথ্যভিত্তিক নয় বলে মনে করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো নানা মতবিরোধ সত্ত্বেও সরকারকে একাট্টা সমর্থন দিয়েছে। সরকার রাজনৈতিক দল ও জনগণের সমর্থন কাজে লাগাতে পারেনি। সমর্থনকে তারা দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করেছে।
সাইফুল হক বলেন, ‘সরকারের প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, দূরদর্শীতা ও খানিকটা সক্ষমতার অভাব আমরা লক্ষ্য করছি। তারা তাদের প্রধান এজেন্ডার বাইরে যেয়ে অনেকগুলো এজেন্ডায় যুক্ত হয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছে, কিছুটা পথ হারিয়ে ফেলেছে। প্রথম দিন থেকে সরকার নিজেদের বিতর্কিত করে ফেলেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নানা মহলে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাদের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সরকার প্রত্যক্ষ ও পরক্ষোভাবে মব সৃষ্টি করেছে। এগুলো করতে যেয়ে সরকার নিজেদের মধ্যে বিতর্ক তৈরি করেছে, নিজেদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে এবং নানা মাত্রিক সংকট সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘ মেয়াদে থাকার প্রকল্প তাদের আরো বেশি বিতর্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সেটাকে এখন দলগুলোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যৌক্তিক নয়।’
সাইফুল হক বলেন, ‘তবে আমি মনে করি তথ্য উপদেষ্টা থলের বেড়াল কিছুটা বের করেছেন। বিএনপি-জামায়াত যেভাবে পদ, পদায়ন, বদলি ইত্যাদি ভাগাভাগি করে নিয়েছে, সে সত্য তিনি সামনে এনেছেন। তাকে ধন্যবাদ।’
গত রোববার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘গণমাধ্যমের স্ব-নিয়ন্ত্রণ ও অভিযোগ ব্যবস্থাপনা : রাজনৈতিক ও নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি’ শীর্ষক সংলাপের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। যুক্তরাজ্য সরকার এবং দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় আয়োজিত এ সংলাপে সম্মানিত অতিথি ছিলেন তথ্য উপদেষ্টা।
সংলাপে সম্প্রচার নীতিমালা, সাংবাদিকের ওয়েজ বোর্ড, বিটিভি ও বেতারে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠাসহ নানা বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান নিয়ে কথা বলেন মাহফুজ আলম। এ সময় রাজনৈতিক দল ও আমলাদের সহযোগিতা না পাওয়ায় অসহায়ত্বও তুলে ধরেন তিনি।
মাহফুজ আলম বলেন, ‘বাংলাদেশে সবাই গোষ্ঠীস্বার্থের জন্য কাজ করে। জাতীয় স্বার্থ দেখে না। সামগ্রিকভাবে কোন জিনিসটা করলে একটা ভালো আইন পাওয়া যাবে, ভালো একটা নীতি পাওয়া যাবে সে বিষয়ে কেউ আগ্রহী না।’ আমলাদের ভাবনা সম্পর্কে এ উপদেষ্টা বলেন, ‘আমলারা পরের সরকারের অপেক্ষায় আছেন। সবাই পরের সরকারের জন্য অপেক্ষা করছেন। এটা হলো ট্রানজিশনাল সরকারের দুর্বলতা।’
বর্তমান সরকারের বড় ক্রাইসিস (সংকট) আছে উল্লেখ করে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘এক মাস ধরে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল যে, ছাত্র উপদেষ্টারা নেমে যাবেন। ফলে ছাত্র উপদেষ্টাদের দপ্তর কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে এক মাস ধরে। সেখানে কাজ শ্লথ হয়ে গেছে।’ জুলাই অভ্যুত্থানের যে প্রত্যাশা ছিল, সে অনুসারে কাজ করা সম্ভব হয়নি বলে স্বীকার করেন মাহফুজ আলম।
তিনি বলেন, দেশে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, মিডিয়া ও সুশীল সমাজ এবং ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মধ্যে যে পারস্পরিক সহযোগিতা রয়েছে, তা অটুট রয়েছে। গণমাধ্যম এখনো ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে।’ সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে ফ্যাসিস্টমুক্ত না করে গণমাধ্যমকে ফ্যাসিস্টমুক্ত করা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তথ্য উপদেষ্টা।
এ ছাড়া দুই মাস ধরে উপদেষ্টা পদ নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। কারণ হিসেবে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মে মাস থেকে ছাত্র উপদেষ্টাদের পদত্যাগ চাওয়ার কথা জানিয়েছেন।
তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘গত দুই মাস ধরে আমি অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি যে, আমি কখন নেমে যাই। মানে আমি কখন নামব আমি জানি না।’ তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোকে চাইতে হবে যে, আসলে এখানে যে বা যারা কাজ করতেছে কাজ করার ক্ষেত্রে ওনারা কীভাবে সহযোগিতা করতে পারবেন। ওনারা কীভাবে অবস্ট্রাকল করবেন না এবং আমাদের কাজগুলো করতে দেবেন।’
মাহফুজ আলম বলেন, মে মাস থেকে রাজনৈতিক দলগুলো বলা শুরু করল যে, ছাত্র উপদেষ্টাদের পদত্যাগ চাই। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর স্লোগান তার সরকারি বাসভবন থেকে শুনতে পেতেন বলেও জানান তিনি।
মাহফুজ আলম আরো বলেন, যেখানে বাকি উপদেষ্টারা গত বছরের আগস্ট মাসে দায়িত্ব নিয়েও বুঝে উঠতে পারছেন না কী করবেন, সেখানে তিনি এমন সময়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন যে, পরদিন তাকে উপদেষ্টা পদ ছাড়তে হয় কি না, তা নিয়েই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। তবে এই সরকারের সময়সীমার মধ্যেই সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তথ্য উপদেষ্টা।
কেকে/ এমএস